দেশের সামাজিক সংকটগুলো গানের মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই
– সাজেদ ফাতেমী, নকশীকাঁথা‘র ভোকালিস্ট
শাহনাজ পারভীন এলিস
বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে ব্যতিক্রমী ধারার গানের দল নকশীকাঁথা ব্যান্ড। মূলত লোকগানের জন্য ২০০৭ সালে নকশীকাঁথা ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল দেশের সামাজিক সংকটগুলো গানের মধ্যদিয়ে তুলে আনা; আর গানগুলোর ভিত্তি হবে লোকজ সুর ও টান। এরপর ২০১০ সালে সেই উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগান বিশ্ববাসীর সামনে এবং বিশ্বের নানান ভাষার লোকগান বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতা ও দর্শকদের সামনে তুলে ধরা। তখন থেকে লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে চলেছে নকশীকাঁথা।
নকশীকাঁথার ধারা নিয়ে আলোচনার আগে সংবাদ সারাবেলা’র পাঠকদের দলটির চলতি ২০২২ সালের কাজগুলোর কিছুটা ধারণা দেয়া দরকার। এ বছর নকশীকাঁথা তাদের বৈচিত্র্যময় ৮টি মৌলিক গান প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে দুটি এবং রমজানের ঈদ নিয়ে ‘মুনাজাতে চাইছি মাফি’, কোরবানির ইতিহাস নিয়ে ‘কোরবানি’ ও পদ্মা সেতু নিয়ে ‘পদ্মার বুকে’ গানগুলো উল্লেখযোগ্য। এ বছর আরও ৬টি গান প্রকাশের জন্য কম্পোজিশনের কাজ চলছে।
এবার নকশীকাঁথার গানের বৈচিত্র্য বুঝতে তাদের প্রকাশিত অ্যালবাম দুটির গানগুলোর প্রসঙ্গে আসি। ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘নজর রাখিস’। ওই অ্যালবামের টাইটেল সং ‘নজর রাখিস’ এর মূল বক্তব্যই হলো- দেশের দিকে নজর দেয়া। উচ্চশিক্ষা বা জীবিকার জন্য সন্তান যে দেশেই যাক না কেন, নির্দিষ্ট একটা সময় পর সে যেন মায়ের কাছেই ফিরে আসে, দেশের কাজেই লাগে। নিজের মেধা ও কর্মক্ষমতার সবটুকু যেন দেশের কাজেই লাগায়। ওই গানে বলা হচ্ছে-
‘নজর রাখিস মগজ না তোর/কাটে ঘুণ পোকায়
রাখিস নজর কইলজাতে তোর/দাগ না পইরা যায়।
কেমন কইরা পালাবি বন্ধু/তেমন কইরা এড়াবি বন্ধু
শেকড়েরই টান/কণ্ঠে তুইলা নে রে বন্ধু
মা-মাটিরই গান/ওরে জন্মভূমির গান।’
এই অ্যালবামে নদী বাঁচানো, পরিবেশ বাঁচানো, বৃক্ষসম্পদ বাঁচানো এবং সেই সঙ্গে মাঠ-নদী-বিল দখল করে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেবার বিরুদ্ধে গানও আছে। যেমন-
‘এখন যেন মেঘেদের ছায়া নেই
ভরা জোৎস্নায় মাখামাখি মায়া নেই
চারদিকে ইট-পাথরের জঞ্জাল
আকাশটা কেড়ে নিয়ে বুড়োদের দল
রেখে গেছে পৃথিবীর কঙ্কাল’।
‘নজর রাখিস’ অ্যালবামে ‘কল্পনার ঘুড়ি’ শিরোনামে একটি ফ্যান্টাসি গেয়েছেন ব্যান্ডের ভোকাল সাজেদ ফাতেমী। বাংলাদেশ ও পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশ-প্রতিবেশও নকশীকাঁথার ভাবনায় থাকে। তারই লেখা ও সুরে ‘কল্পনার ঘুড়ি’ শিরোনামে গানটিতে তিনি ১০০ বছর পরের পৃথিবীর সম্ভাব্য এক রূপ তুলে এনেছেন। তবে পৃথিবীটা সেই রূপে মানুষের সামনে আসুক, সেটা চায়না নকশীকাঁথা। তিনি লিখছেন-
‘একশ বছর পরে কি হবে বলি শোনো মন দিয়া
যন্ত্রমানব করে দেবে দরকারি কাজ যতো
বুদ্ধি বিবেচনা হবে মানুষেরই মতো
জিনপ্রযুক্তির ব্যবহারে হবে নানান চেঞ্জ
সৎ এবং বদ মানুষের গুণ হবে এক্সচেঞ্জ
সাগর নদী শুকিয়ে যাবে চিহ্ন রবে না
পানির জন্য বাধবে যুদ্ধ পানি মিলবে না’।
এই গানটি দেশের ঐতিহ্যবাহী অথচ বিলুপ্তপ্রায় জারিগানের আদলে তৈরি করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘নকশীকাঁথার গান’-এ যেমন দেশের গানেই বুঁদ হয়ে থাকার আহ্বান আছে, তেমনি আছে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া অনিয়ম ও দুর্নীতির নাটের গুরুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গান। সেই গানে একটি সিঁচকে চোর ছোট থেকে ধীরে ধীরে কী করে বড় চোরে পরিণত হয়, বিভিন্ন প্রবাদ সন্নিবেশিত করে তার প্রকাশ ঘটানো হয়েছে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে। যেমন-
‘আতি চোর পাতি চোর/হতে হতে সিঁধেল চোর
লতা চুরি পাতা চুরি/শ্যাষে রাজার হাতি চুরি
চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা/যদি না পড়ে ধরা
যদি পড়ে ধরা তবে/হাতে পায়ে কড়া’।
নকশীকাঁথা সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয় না। তারা সময়ের আলোচিত সমস্যাগুলো উপজীব্য করে গান তৈরি করে; যা সেই সময় ও তৎপরবর্তী সকল সংকটকালে মানুষ মনে রাখে। নিজেদের সম্পর্কেও তারা লিখেছেন-
‘স্রোতে গা ভাসায় দেই না
বাইয়া যাই উজান।
হাওয়ায় কথা উড়াইনা
কথার রাখি মান।
দেহেরও খাঁচায় যেমন
লুকায় থাকে প্রাণ
সাথে আছি সবসময়
গাই দ্যাশেরই গান’।
নকশীকাঁথা ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হলেন সাজেদ ফাতেমী। সারগাম-এর সাথে আলাপকালে তিনি জানান, আমাদের সব গানেই লোক সুরের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ গানে বিলুপ্তপ্রায় পুথি, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতি ইত্যাদি গানের সুর ও ধারা ব্যবহৃত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা আজ উপেক্ষিত। নিজের মাতৃভাষার প্রতি উপেক্ষা ও অবহেলা নকশীকাঁথার সদস্যদের কষ্ট দেয়। বাংলা ভাষার বিরোধিতাকারীরা সব আমলেই সক্রিয় ছিল, এখনো আছে। তাই আমি আমাদের জন্য গান লিখেছি-
‘আমার মাতৃভূমির মায়ের ভাষা
বাংলা ভাষার দুর্গতি
পড়ছে চোখে চারদিকে আজ
চলছে এক তেলেসমাতি
আমরা মুখে বলছি ভালোবাসি
নেই দলিল দস্তাবেজে
বাংলাভাষার বারোটা বাজে
এখন বাংলা নেই কোনো কাজে
বাংলাভাষার বারোটা বাজে’।
বাংলা, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা লোকগানের পথিকৃত ব্যক্তিত্বদের সম্মান জানাতে ভোলে না নকশীকাঁথা। তাদের ‘বন্দনা’ শিরোনামে গানে তা প্রকাশ পেয়েছে। ওই গানে সাজেদ ফাতেমী লিখেছেন-
‘আমার দ্যাশের ভাণ্ডারে আছে বিবিধ রতন
রবীন্দ্রনাথ নজরুল হাসন মুকুন্দ লালন
জারি সারি কীর্তন ঘাটু গম্ভীরার সুরে
পালা ভাটিয়ালী বিচার সবার হৃদয়জুড়ে
এখনো ভোলা মন বলে মাঝি মারে টান
সেই টানেই এলাম ফিরিয়া দিলাম সঁপে মন।
——–
এই দ্যাশেরই মাটিতে দ্যাশেরই মাঠেতে
সোনালি ফসল ফলে
সেই ফসলের ভাতে রূপালি মাছেতে
মোদেরই জীবন চলে
বাংলার লোকগানের সুরে-তালে ছন্দপতন
দেখেছে কে কোথায় কবে।
তাই দেশেরই সুরেতে এ বিশ্ব ঘুরিতে
ভাসালাম এ তরী সবে।’
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে একনিষ্ঠভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাম না জানা সাধকদের গান সংগ্রহ ও তাদের সান্নিধ্যে এসে নিজেদের সমৃদ্ধ করে চলেছেন নকশীকাঁথার সদস্যরা। এর মধ্য দিয়ে তারা বাঙালি ও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে লোকগানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের রূপটি তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। দুটি অ্যালবামসহ এ পর্যন্ত নকশীকাঁথার প্রকাশিত গানের সংখ্যা ৭০টি।
এবার, দেশের লোকগানের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড নকশীকাঁথার প্রতিষ্ঠাতা ভোকালিস্ট সাজেদ ফাতেমী সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা দিতে চাই। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, উপস্থাপক, গায়ক, সাংবাদিক- সর্বোপরি লোকগানের গবেষক। লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে। পাঁচটি টেলিভিশন চ্যানেলে লোকগানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন প্রায় ১৪ বছরে। তিনি পড়াশোনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। পেশাগত জীবনে সংগীতের পাশাপাশি তিনি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে জনসংযোগ পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০১৮ সালে ওই ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের আগ পর্যন্ত তিনি প্রথম আলোসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি পত্রিকায় ২২ বছর সাংবাদিকতা করেছেন। সক্রিয়ভাবে থিয়েটার করেছেন ১২ বছর। এই সময়ে ২০টি মঞ্চ নাটকে অভিনয় এবং ৪টি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনাও দিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন নাটকের এনজিও থিয়েটার ফর রিসার্চ এডুকেশন অ্যান্ড এম্পাওয়ারমেন্ট-ট্রি। এই সংগঠন নিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে নানা সামাজিক সংকট মোকাবিলায় সচেতনতার নাটক ও গান করে বেড়িয়েছেন ৭ বছর (১৯৯৯-২০০৬)।
পেশাগত সংগীতজীবনের সাজেদ ফাতেমীর প্রায় ২০ বছরে ব্যক্তিগত দুটি একক অ্যালবাম এবং তার লেখা, সুর ও আয়োজনে মোট ১১টি অডিও অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টে অংশ নিয়ে তিনি এবং তার দল নকশীকাঁথা দারুণ আলোচনায় আসে। এছাড়া দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে এই ব্যান্ডদল নিয়মিত কনসার্টে অংশ নিচ্ছে।
নকশীকাঁথার লাইনআপ – সাজেদ ফাতেমী: ভোকালিস্ট ও পারকেশনিস্ট। জে আর সুমন: লিড গিটার, রাবাব ও ম্যান্ডোলিন। বুলবুল: কাহন, ঢোল ও তবলা। রোমেল: কি-বোর্ড ও মেলোডিকা এবং ফয়সাল: বেইজ গিটার।