Search
Close this search box.

খণ্ডিত বাংলাদেশ

খণ্ডিত বাংলাদেশ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

‘আইনের শাসন’ বলে একটা কথা আছে, যা খুব উচ্চারিত হয়। আইনি ন্যায়বিচারের সঙ্গে এই ধারণা জড়িত, যার মোদ্দাকথা, আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু আইন কারও কারও জন্য যে বেশি সমান সেটারও উদ্যোগ থাকে মাঝে মধ্যে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সম্প্রতি ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল অ্যান্ড সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মস, ২০২১’ শীর্ষক প্রবিধানের চূড়ান্ত খসড়া হাইকোর্টে জমা দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের সরল বিশ্বাসে (গুড ফেইথ) করা কোনও কাজের জন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করা যাবে না। রাষ্ট্র যদি মানুষের হয়, তাহলে সে প্রতিকার চাইতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে যারা তার সর্বনাশ করলো? এরকম আইন যারা প্রণয়ন করতে পারেন বা ভাবতে পারেন, তাদের মনোজগতে স্পষ্ট করে আছে যে রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের চাইতে তারা বড়, তারাই পূজনীয়, তারা যা করবে, যত অন্যায় করুক সব বৈধ। এরকম দায়মুক্তি দিয়ে যে প্রবিধান চূড়ান্ত করেছে, তা কেবল প্রশ্নবিদ্ধ নয়, সংবিধানেরও পরিপন্থি।

এই প্রবিধানের অধীনে কোনও আদেশ বা নির্দেশনার বাস্তবায়নে সরল বিশ্বাসে করা কোনও কাজের জন্য কোনও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি মন্ত্রী বা সরকারের কোনও কর্মচারী, বিটিআরসির চেয়ারম্যান বা কমিশনের অন্য কোনও কর্মকর্তা, কর্মচারী বা পরামর্শকের বিরুদ্ধে কোনও ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারবেন না। শুধু মন্ত্রী বা সরকারি কর্মচারী হওয়ার কারণে তারা মানুষের বিরুদ্ধে যেকোনও কিছু করে পার পেয়ে যাবেন তথাকথিত ‘সরল বিশ্বাস’ নামের তকমায়! তাদের এই সরল বিশ্বাস যে প্রকৃত অর্থেই গরল, সেটা মানুষ তো জানে। একটা জিনিস বুঝতে পারা যায় যে বাংলাদেশের মানুষকে ভাবতে হবে অন্যায়কারী বা অপরাধ সংগঠনকারী কোন সম্প্রদায় বা শ্রেণির। মন্ত্রী, সচিব বা ক্ষমতা কাঠামোর কেউ? আজকের উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশের আমলাদের একজন? এমন সৌভাগ্য কোনও দেশের মন্ত্রী বা সরকারি কর্মীদের আছে কিনা জানা নেই। তাহলে তো বলতেই হয়, অন্যায়কারী কেবল সাধারণ মানুষের ভেতরই আছে, উচ্চস্তরের মানুষ তথা মন্ত্রী, আমলারা সব ক্ষেত্রেই নির্দোষ।

এই খসড়া প্রবিধানে উদ্দেশ্য পূরণের কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের দায়মুক্তি দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে দেশের মানুষের সমতা ও আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন নিয়ে আমরা কত কথা বলি, অথচ আমাদের আলোকপ্রাপ্ত গণতন্ত্রে মানুষকেই অস্বীকার করার এই যে প্রবণতা সেটা মানুষের অধিকার কেড়ে নেয় আক্রোশে শুধু নয়, অবহেলা ও অবজ্ঞায়ও। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণে রাষ্ট্রের গঠনে একটা বিশাল সংযুক্তি ঘটেছে, যার নাম প্রশাসন। সেই প্রশাসন কাজ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে এবং সেই নেতৃত্ব মানুষই ঠিক করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনি ব্যবস্থায়। এখন সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি তার অধীনস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে সরল বিশ্বাসের অনিয়ম ভাগাভাগি করে তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?

সরকারি কর্মকর্তারা সর্বত্র এই ‘সরল বিশ্বাস’ কথাটার চর্চা করে। কিন্তু এই সরল বিশ্বাস সরল নয়। কে অপরাধী, কে নয়, সেটা ঠিক করবে আদালত। কিন্তু আইন বলে কাউকে আগাম দায়মুক্তির এমন বিধান সংবিধানের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, বহু ত্যাগ আর সংগ্রামের বিনিময়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শেরও বিরুদ্ধে। ‘ছোটদের বড়দের সকলের’ মুক্তিযুদ্ধ হয়নি মন্ত্রী আর আমলাদের আলাদা করে দেখবার জন্য। রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সরল বিশ্বাস দিয়ে চলে না। চলতে হয় আইনের ভিত্তিতে। সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে যদি সরল বিশ্বাসকে আমলে নেওয়া হয়, তাহলে একজন সাধারণ নাগরিক কেন সেই সরল বিশ্বাসের সুবিধা পাবে না? তার আমার সব কৃতকর্মকেও সরল বিশ্বাস বলেই ধরে নেওয়া হোক। ন্যায়বিচার সর্বজনীন। এখানে কোনও বাছবিচার চলে না। ‘সর্বজনীন’ আইনের শাসন তখনই সফল হতে পারে, যখন তার প্রয়োগ ঘটে ‘সর্বজনীন’ সদস্যদের ওপর, যারা নির্দিষ্ট পরিচয়ের দ্বারা আবদ্ধ নয়। সরকারি কর্মচারী আইনে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে গ্রেফতারের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার যে বিধান আছে সেটাও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিটিআরসির এই প্রবিধান বলে দেয় যে বাংলাদেশে আসলে এখন দুই ধরনের নাগরিক: একদল ‘সাধারণ’ (কোনও বিশেষ পরিচয়ের নয়), অন্যরা সরকারি কর্মচারী। অবশ্য শাসন ব্যবস্থায় সরকারি কর্মীদের দাপট কায়েম করতে গিয়ে ‘নাগরিক’ শব্দটি সংকুচিত হতে হতে বিলুপ্তির পর্যায়ে চলে গেছে। নাগরিকের এখন কোনও পাত্তা নেই শাসন ব্যবস্থার কোন স্তরেই। তারপরও সরল বিশ্বাসের সরকারি সমীকরণকে এমন প্রশ্রয় দেওয়া যায় না।

মুক্তিযুদ্ধের পর গণতন্ত্রের আধুনিক পন্থায় সবার সমানাধিকার ও বঞ্চিতদের জন্য রক্ষাকবচের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল, ক্ষমতাবানরা আজ সেই সংবিধানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন এমন সব আইন আর প্রবিধানের কথা ভেবে। তবে কী, সাধারণ মানুষ আজ সমাজ থেকেই বহিষ্কৃত? রাষ্ট্র কি কেবল তার নিরলস শ্রমটুকুই চায়, তাকে চায় না?

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ