সুমায়রা রহমান- ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে নদীতে ইলিশ শিকারে নেমে ঢাউস সাইজের পাঙাশ ধরা পড়েছে জেলেদের জালে। বরিশালের জেলেরা বলছেন, জালে আশানুরূপ ইলিশ না মিললেও পাঙাশ সেই স্থান পূরণ করে দিয়েছে। প্রতিটি জালে ১৫ থেকে ২০টি পাঙাশ ধরা পড়েছে। সর্বোচ্চ ২৫ কেজি থেকে সর্বনিম্ন ৫ কেজি ওজনের পাঙাশ রয়েছে। তার সঙ্গে বড় বড় সাইজের ইলিশ থেকে শুরু করে জাটকা ইলিশও ধরা পড়ছে।
ইলিশের মোকাম হিসেবে পরিচিতি বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডে ফিরে এসেছে প্রাণ চাঞ্চল্য। দীর্ঘদিন ইলিশ শিকার বন্ধ থাকায় এর সঙ্গে জড়িতদের অলস সময় কাটাতে হয়েছে। সেখান থেকে বের হয়ে ইলিশের সাইজ নির্ধারণ শুরু করে ট্রলার থেকে ইলিশ নামানো এবং মাপ দিয়ে তা বরফজাত করাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন তারা। তার মধ্যে বড় বড় সাইজের পাঙাশ সকলের চোখমুখে এনে দিয়েছে বাড়তি আনন্দ।
মেঘনা নদীতে ইলিশ শিকার করে পোর্ট রোডে ট্রলার নিয়ে আসা জেলে মোজাম্মেল হোসেন জানান, নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় আগেভাগেই ট্রলার ছেড়ে নদীতে যান। গত রাত সাড়ে ১১টার দিকে জাল ফেলেন। ৩ ঘণ্টা পর জাল যখন টান দিচ্ছিলেন তখন ভারে তাদের কাছে মনে হয়েছে জাল ভর্তি ইলিশ। আনন্দে জাল টেনে কাছে আসতেই বড় বড় সাইজের পাঙাশে তাদের চোখেমুখে আনন্দ ফুটে ওঠে। প্রথমবার তাদের এক জালে ছোট-বড় ২২টি পাঙাশ উঠেছে। এর সাথে বড় ও ছোট সাইজের ইলিশও ছিল। তবে যে পরিমাণ ইলিশের আশা করেছিলেন তা ওঠেনি। সর্বোচ্চ ২০ কেজি ওজনের পাঙাশও পেয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, তিনবার জাল টেনে ৫৩ পিস পাঙাশ তুলেছেন। তবে জালের প্রকার ভেদে অনেকে এর চেয়ে বেশি পাঙাশ শিকার করেছেন। এ মৌসুমে পাঙাশ ধরা পড়ার বিষয়টি তারা আগেভাগেই জানতেন। তবে এত পাঙাশ উঠবে তা তারা আশা করেননি।
ভোলার তেতুলিয়া নদীতে ইলিশ শিকার শেষে পোর্ট রোডে আসা জেলে কাঞ্চন বলেন, ‘২৫ বছরের ধারণা থেকে বলতে পারি, এত পাঙাশ আর কখনও ইলিশের জালে ওঠেনি। গত রাতে আমাদের আশা ছিল জাল ভরে বড় বড় সাইজের ইলিশ উঠবে। কারণ ২২ দিন জাল ফেলা হয়নি। এ কারণে ২২ দিনের ইলিশ রয়েছে নদীতে। কিন্তু আমাদের জালে ইলিশ ওঠেনি, উঠেছে পাঙাশ।
ইলিশের দুঃখ পাঙাশে ভুলে গিয়েছি’ বলে এক গাল হাস দিলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আসলেই আমরা অনেক খুশি। যে পরিমাণ ইলিশ জালে ওঠার আশা ছিল, তা না উঠলেও পাঙাশ সে স্থান পূরণ করে দিয়েছে। আমরা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।‘ তাছাড়া ইলিশ যে পরিমাণ ডিম ছেড়েছে, তা বড় হতে পারলে আগামী মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
পোর্ট রোডের ইলিশের আড়তদার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মা ইলিশের যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সে সময়টা সঠিক ছিল। তবে সময়টা আরও বাড়ানো দরকার। কারণ নদী থেকে যে ইলিশ আসছে তাতে ডিম রয়েছে। এক মাস সময় বেধে দিলে ওই মাছগুলোও ডিম ছাড়তে পারতো।’ তারপরও নিষেধাজ্ঞা সফল হয়েছে বলে দাবি করলেন তিনি।
অপর আড়তদার জহির সিকদার বলেন, ‘আজ জেলে ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দারুণ খুশি। কারণ তারা যে পরিমাণ ইলিশ শিকারের আশা করেছিলেন, তা না না পেলেও পাঙাশ সে জায়গাটা পূরণ করে দিয়েছে। প্রতিটি ট্রলার থেকে ইলিশের সাথে সাথে বড় সড় সাইজের পাঙাশ নামছে। ২শ’ মণের অধিক পাঙাশ এসেছে আজ। যা ৫শ’টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ অন্য সময় এ মাছের কেজি বিক্রি হতো ৬শ ৮শ’টাকা কেজি দরে।
তিনি আরও বলেন, ‘আড়াই কেজি থেকে শুরু করে দুই কেজি ও এক কেজি ওজনের ইলিশসহ জাটকা ইলিশও ধরা পড়েছে। তবে কিছু কিছু মাছের পেটে ডিম পাওয়া গেছে। তবে তার পরিমাণ তেমন বেশি নয়।’ এ বছর নিষেধাজ্ঞা সফল হয়েছে বলে দাবি করলেন এই আড়তদারও।
জহির বলেন, ‘দুই কেজি ওজনের ইলিশের মণ ৮০ হাজার টাকা, ১২শ’ গ্রাম ৫০ হাজার, কেজি সাইজের ৪৬ হাজার, রফতানিযোগ্য এলসি সাইজ ৩৮ হাজার এবং ভেলকা প্রতি মণ ৩২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর ভোলার মেঘনায় ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। এতে হাসি ফুটেছে জেলেদের মুখে। ব্যস্ততা বেড়েছে জেলেপাড়ায়। সরগরম হয়ে উঠেছে মাছের আড়ত। ইলিশ ধরার উৎসবে মেতে উঠেছেন জেলেরা। ইলিশ বিক্রির টাকায় বিগত দিনের ক্ষতি পুশিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে আশাবাদী জেলেরা। আড়ৎগুলোতে লাখ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হচ্ছে। সেই মাছ চলে যাচ্ছে বাইরের জেলাগুলোতে।
নিষেধাজ্ঞা শেষে নদীতে শত শত নৌকা ও ট্রলার নিয়ে জেলেরা নেমে পড়েছেন ইলিশ শিকারে। প্রথম দিনেই ভালো পরিমাণে মাছ পাওয়ায় খুশি তারা। জেলে জসিম, শামসু ও খালেক বলেন, ‘আমরা রাতেই নদীতে গিয়েছি। যে পরিমাণ মাছ পেয়েছি তাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো বলে আশা রাখছি। ধারদেনাও পরিশোধ করতে পারবো।
এদিকে, ঘাটগুলোতে পাইকার, আড়তদার ও জেলেদের কর্মব্যস্ততায় সরগরম হয়ে উঠেছে মাছের আড়ত। ভোলা সদরের তুলিতলী মাছ ঘাটের আড়তদার মনজুর আলম বলেন, ‘নদীতে মোটামুটি ভালো ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এতে জেলেরাও খুশি, আমরা আড়তদাররাও খুশি। প্রথমদিন এ ঘাটে ৬০ লাখ টাকার মাছের কেনা-বেচা হয়েছে। ইলিশ ধরা পড়ায় নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো বলে আশা করছি।
এ বছর ইলিশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে মনে করছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ইলিশের অভিযান সফল হওয়ায় নদীতে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। দ্বীপজেলা ভোলায় ইলিশ ধরে জীবিকা চালান এমন জেলের সংখ্যা তিন লাখের অধিক।