Search
Close this search box.

বিশ্বজয়ের স্বপ্নপূরণে সর্বকালের সেরা ফুটবলার মেসি!

মেসিসহ বিশ্বকাপের ২৬ ফুটবলার নিয়ে আর্জেন্টিনার দল ঘোষণা

মিথুন আশরাফ

এক বিশ্বকাপ জয়, ১ কোপা আমেরিকা, ১ অলিম্পিক স্বর্ণ, ৭ ব্যালন ডি’অর, ৪ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ১০ লা লিগা, ১ লিগ ওয়ান, ১০০৩ ম্যাচ, ৭৯৩ গোল, বিশ্বকাপে ১৩ গোল, ৮ গোলে অ্যাসিস্ট, বিশ^কাপে ২ সোনার বল জয়; সর্বকালের সেরা হতে আর কী লাগে!

কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ শেষে এখন সবার মুখে এই একটি উচ্চারণই। মেসিকে সর্বকালের সেরা বলা হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বকাপের শুরুতেও একটি নামই সবার মুখে উচ্চারিত হয়েছে, লিওনেল মেসি। যখন বিশ^কাপের পর্দা নামে তখনও একটি নামই কন্ঠে, শুধুই মেসি। অবশেষে বিশ্ব জয় যে করেছেন। শুধু কি তাই। ইতিহাসের পাতা ওলট পালট করে দিয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় এখন শুধুই মেসি। সর্বকালের সেরা মেসি।

রবিবার রাতে লুসাইল স্টেডিয়ামে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে গেছে। বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি যেন ইতিহাসের সব ম্যাচকেই ছাড়িয়ে গেছে। কী উত্তেজনা। কী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কী শ্বাসরুদ্ধক ম্যাচ। এমন ফাইনাল ম্যাচ এর আগে বিশ্বকাপে কখনো কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স; দুই দলই অসাধারণ খেলা উপহার দিয়েছে। শেষপর্যন্ত নির্ধারিত সময়ের খেলা ২-২ গোলে ড্র হওয়ার পর অতিরিক্ত সময়ের খেলাতেও দুই দলই একটি করে গোল দেয়। তাতে করে ৩-৩ গোলে খেলা শেষ হয়। টাইব্রেকারে গিয়ে আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক মার্টিনেজ ফ্রান্সের একটি শট আটকে দেন। আরেকটি শটে গোল করতে ব্যর্থ হয়। তাতে করে আর্জেন্টিনা ৪-২ গোলে জিতে বিশ^চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। তবে খেলায় যে শেষমুহুর্ত পর্যন্ত টান টান উত্তেজনা ছিল, তা বিশ্ব মাতিয়ে দিয়েছে। মহা আনন্দ দিয়েছে।

এরআগেও ৬ গোল বা তার বেশি গোলের ফাইনাল ম্যাচ দেখার মিলেছে। কিন্তু একবার একদিকে, আরেকবার আরেকদিকে জয়ের পাল্লা হেলে গেছে, এমন ‘হার্টফেল’ করা ম্যাচ এরআগে কখনো দেখার মিলেনি। হৃদস্পন্দনই থেমে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল।

আর্জেন্টিনা প্রথমার্ধে অবশ্য একতরফাই খেলেছে। ২-০ গোলে এগিয়ে গেছে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধেই খেলা ঘুরে যায়। ডি মারিয়াকে যেই আর্জেন্টিনা উঠিয়ে নেয়, খেলাই যেন ফ্রান্সের দিকে ঘুরে যায়। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে আর্জেন্টিনার বারোটা বাজিয়ে দিতে থাকেন ফ্রান্স ফুটবলাররা। কিলিয়ান এমবাপ্পেতো শেষপর্যন্ত হ্যাটট্রিকই করে বসলেন। মেসি জোড়া গোল করলেন। তবে রাতটি ছিল মেসির। আর তাই যত ঝড়ই আসুক, শিরোপা উচিয়ে ধরবেন মেসি, এ যেন নিয়তিতেই লেখা ছিল। তাই হলো।

শুধু তাই নয়, এক এক করে পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলে পঞ্চম বিশ্বকাপে এসে বিশ্ব জয়ের স্বপ্নপূরণের সঙ্গে দুটি বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হয়ে সোনার বল জেতার ইতিহাস শুধু মেসিই গড়েছেন। আর কেউ তা গড়তে পারেননি। ২০১৪ সালে অল্পের জন্য স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। এবার স্বপ্নপূরণ হলো। শুধু কী স্বপ্নপূরণই হলো, সবকিছুই তো বিশ^জয়ের সঙ্গে পেয়ে গেলেন মেসি। সর্বোচ্চ সুখের সন্ধানও পেয়ে গেলেন।

ফাইনালের আগে পাঁচ বিশ্বকাপে মেসি ১১টি গোল করেন। যা বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড হয়ে যায়। ফাইনালে আরও ২টি গোল করে সবাইকে ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে যান মেসি। প্রথমবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদও পান মেসি। এই একটি আক্ষেপই ছিল। তাও পূরণ হয়ে গেল। আর্জেন্টিনার বিশ^চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দীর্ঘ ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসানও ঘটালেন মেসি।

বিশ্বের সর্বকালের সেরা এই ফুটবলার আলোচনায় এসেছেন আগেই। পেলে এবং ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে তার। প্রথম দুজন বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেলেও মেসি এতদিন পাননি। তবু ফুটবলার হিসেবে দক্ষতা এবং সাফল্য তাকে নিয়ে এসেছে সর্বকালের সেরার লড়াইয়ে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় এবার যেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার হওয়ার কাতারেই চলে গেলেন মেসি।

ফাইনালে নেমে রেকর্ডের ঝুলিও ভরেছেন। ২০০৬ সাল থেকে ফুটবল বিশ্বকাপের ২৬টি ম্যাচ খেলে জার্মানির বিশ্বজয়ী সাবেক অধিনায়ক লোথার ম্যাথিউজকে (২৫টি ম্যাচ) পেছনে ফেলে বিশ্বকাপের সব থেকে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড গড়েছেন। বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ফুটবলার এখন মেসি।

সময়ের হিসেবে মেসি সবচেয়ে বেশি সময় খেলার রেকর্ডও গড়েছেন। ফাইনালের আগে ২১৯৪ মিনিট খেলেছিলেন। যা দ্বিতীয় সেরা ছিল। ইতালির সাবেক ফুটবলার পাওলো মালদিনির (২২১৭ মিনিট) চেয়ে ২৪ মিনিট কম খেলেছিলেন। ফাইনালে পুরোটা সময়ই খেললেন। সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন।

ফাইনালের আগে বিশ্বকাপে ২৫টি ম্যাচ খেলে মেসি ১৬টি ম্যাচে জয়ের স্বাদ পান। ফাইনালে জিতে বিশ্বকাপের ১৭তম ম্যাচ জেতার সুবাদে জার্মানির সাবেক ফুটবলার মিরোস্লাভ ক্লোজের রেকর্ড স্পর্শ করেন মেসি।

মেসি একবার বিশ্বকাপে সেরা ফুটবলারও হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের বিশ^কাপে। জিতেছিলেন সোনার বল। এবার কাতারেও সোনার বল জিতে বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে দুবার সোনার বল জেতার রেকর্ড গড়লেন। কেউ এরআগে দুটি বিশ্বকাপে সেরা ফুটবলার হতে পারেননি। মেসি তা হয়ে দেখালেন। এক ফাইনাল ম্যাচ জিতে, সব প্রাপ্তি যেন মেসির মাথায় মুকুট হয়ে ধরা দিল। অবশেষে যে বিশ্বকাপ জিতলেন মেসি। স্বপ্নপূরণও হলো।

তিনিই যে সর্বকালের সেরা ফুটবলার তা বলে দিয়েছেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি। তার চোখে সর্বকালের সেরা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তার কাছে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার। তিনি বলেছেন, ‘মেসি যে ইতিহাসের সেরা ফুটবলার এটা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। অনেকেই ভাবতে পারেন আমরা আর্জেন্টাইন বলে হয়তো কথাটা বলি। কিন্তু আসলে তা না। যখনই সে মাঠে নামে কোনো না কোনো সুযোগ তৈরি করবে। তাকে খেলতে দেখা তার সতীর্থ, আর্জেন্টাইন সমর্থক, পুরো বিশ্বের জন্য বড় এক অনুপ্রেরণা। তাকে কোচিং করাতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি।’

ইংল্যান্ডের সাবেক স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার তো প্রশ্নই ছুড়ে দিয়েছেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা টুইট করেছেন, ‘এখনো কি বিতর্কটা আছে? আমি সর্বকালের সেরার কথা জিজ্ঞেস করছি।’

যাঁরা মেসিকে এগিয়ে রাখেন না, তারা মেসি যে বিশ্বকাপ জিতেননি, সেই বিতর্ক সামনে তুলে ধরেন। এবার তো সেই বিতর্কও শেষ। গত বছর আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন করালেন মেসি। তাতেও কাজ হয়নি। এতদিন বিশ্বকাপ যে জেতাতে পারেননি। এবার জিতিয়ে দিলেন। তাতে আর কোন বিতর্কই থাকল না।

ইংল্যান্ডের সাবেক আরেক ডিফেন্ডার জেমি ক্য়ারাঘারতো টুইট করে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মেসিই হলেন সর্বকালের সেরা।’ একটি বিশ্বকাপ জেতা হলো। এরআগে একটি কোপা আমেরিকা জিতেছেন। অলিম্পিকে একটি স্বর্ণ জিতেছেন। ৭টি ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন ৪ বার। লা লিগা (স্পেনের ঘরোয়া লিগ) জিতেছে ১০ বার। লিগ ওয়ান (ফ্রান্সের ঘরোয়া লিগ) জিতেছেন ১বার। ম্যাচ খেলেছেন ১,০০৩টি। গোল করেছেন ৭৯৩টি। বিশ্বকাপে ১৩টি গোল করেছেন। সঙ্গে আটটি গোল তিনি অ্যাসিস্ট করেছেন। আর কী লাগে। দুইবার বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলার হয়ে, সোনার বল জিতে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন মেসি।

বিশ্বকাপ শুরুর আগেই তো মেসির প্রতিদ্বন্দ্বি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বলে দিয়েছিলেন, মেসি একজন জাদুকরী ফুটবলার। বিশ্বকাপ জিতে সেই জাদুর ছোয়াই শুধু মিলল না, সর্বকালের সেরা ফুটবলারই হয়ে গেছেন মেসি!

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ