Search
Close this search box.
প্রথম যাত্রী হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

স্বপ্নের মেট্রোরেল উদ্বোধন কাল

রাকিব হাসান- অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে। ঢাকার বুকে চালু হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। রাত পোহালেই  বহুল প্রতীক্ষিত এ মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সাথে স্বপ্নের মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রী হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন তিনি মেট্রোরেলে চড়েই অফিস করবেন। উত্তরায় জনসমাবেশে ভাষণ শেষে মেট্রোরেলের উদ্বোধনের ঘোষণা করবেন। এরপর উত্তরা উত্তরস্টেশনে এসে ট্রেনের টিকিট কাটবেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর মেট্রোরেলে চড়ে আগারগাঁওয়ের পথে রওনা হবেন। এরপর আগারগাঁও থেকে তিনি নিজ কার্যালয়ে চলে যাবেন।

মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাত্রী হিসেবে যারা উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যাবে তারা ফিরতি ট্রেনে উত্তরা উত্তরস্টেশনে ফিরে আসবে। ওই দিন ট্রেনটি আর কোনো যাত্রী পরিবহন করবে না।

পরদিন বৃহস্পতিবার থেকে যাত্রীদের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকবে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। আপাতত প্রথম দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। এই সময়ে যাত্রী পরিবহন করা হবে। পরবর্তী সময়ে যাত্রী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের সময়সূচি নির্ধারণ করা হবে।

মেট্রো রেললাইন-৬-এর উপপ্রকল্প পরিচালক (গণসংযোগ) নাজমুল ইসলাম ভূইয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর ওই দিনের কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদন করা হবে।

এদিকে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে উদ্বোধনের দিন উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের উত্তরা পার্ক মাঠে জনসমাবেশ করবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।

প্রাথমিকভাবে সীমিত পরিসরে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে এ উড়াল ট্রেন। এ পথের দূরত্ব ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। উদ্বোধনের দিনই এ দুটি স্টেশন খুলে দেওয়া হবে। সে মোতাবেক সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়েছে। মেট্রোরেলের এ অংশের বাকি সাতটি স্টেশনও পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে খোলা হবে।

তবে মেট্রোরেল প্রতিদিন এই চার ঘণ্টা একটানা চলবে নাকি সকাল–বিকেল দুই ভাগে চার ঘণ্টা চালানো হবে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী পরবর্তীসময়ে এ শিডিউল ঠিক করা হবে।

সরকারি মালিকানাধীন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উদ্বোধনের পর কিছুদিন মেট্রোরেল দিনে চার ঘণ্টা করে চলাচল করবে। এজন্য পাঁচটি ট্রেন থাকবে। তবে এরই মধ্যে ১২টি ট্রেন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শুরুর দিকে পাঁচটি ট্রেনের বেশি প্রয়োজন হবে না। মাস তিনেক পর হয়তো সবগুলো ট্রেন চলাচল শুরু করবে।

ডিএমটিসিএলের উপ-প্রকল্প পরিচালক (গণসংযোগ) বলেন, প্রথম দিন মাত্র দুটি স্টেশন খুলে দেওয়া হবে। একটি উত্তরা উত্তর অন্যটি আগারগাঁও স্টেশন। মেট্রোরেলের ধারণা আমাদের জন্য একেবারেই নতুন, তাই শুরুতে যাত্রীদের প্রশিক্ষণের বিষয়ও আছে। পরে যাত্রী চাহিদা অনুযায়ী এক এক করে অন্য স্টেশনগুলো খোলা হবে। এর মধ্যে মিরপুর স্টেশনটি হয়তো অন্যগুলোর আগে খুলে দেওয়া হতে পারে।

ডিএমটিসিএল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার পথে মোট ৯টি স্টেশন রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি), উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও। উদ্বোধনী দিনে শুরু ও শেষের স্টেশনটি খুলে দেওয়া হবে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দুটি স্টেশনই পুরোপুরি প্রস্তুত। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে উভয় স্টেশনেই পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে।

সরকার মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করেছে ২০ টাকা। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া হবে ১০০ টাকা। প্রথম পর্যায়ে মেট্রোরেল যে অংশে চলাচল শুরু করবে, সেই উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত যাত্রীপ্রতি ভাড়া হবে ৬০ টাকা।

এছাড়া উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে উত্তরা সেন্টার (মধ্য) ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের ভাড়া হবে একই ২০ টাকা। উত্তরা উত্তর থেকে পল্লবী ও মিরপুর-১১ স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৪০ টাকা এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ টাকা।

ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১) বা বাংলাদেশের প্রথম পাতাল রেল নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে অনুমোদিত হয়েছে।

ঢাকা মহানগরী ও তৎসংলগ্ন পাশ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে ও পরিবেশ উন্নয়নে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি মেট্রোরেলের সমন্ধয়ে একটি শক্তিশালী নেটওর্য়াক গড়ে তোলার জন্য সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে।

২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের স্টাডি রিপোর্টে প্রথমবারের মতো এমআরটি (ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) করার প্রস্তাব করা হয়। এরপর জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ২০০৮ সালে এতে যুক্ত হয়। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সরকার ঢাকায় স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) তৈরি করে। ওই এসটিপিতে তিনটি এমআরটি লাইনের প্রস্তাব করা হয়। এসটিপির ওপর ভিত্তি করে জাইকা ২০০৮ সালে আরবান ট্রাফিক ফরমুলেশন স্টাডি করে। ওই সময়ে এমআরটি লাইন ৬-কে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১০-১১ অর্থবছরে সমীক্ষা জরিপ (ফিজিবিলিটি স্টাডি) চালানো হয়।

বাংলাদেশে জাইকার প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহিদে এক সাক্ষাৎকারে মেট্রোরেলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। তিনি বলেন, আমরা এমআরটি প্রকল্পে প্রথম যুক্ত হই ২০০৮ সালে। ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়ে যাওয়ার পরে আমরা ঋণ চুক্তি সই করি। ২০১৩ সালে প্রথম ঋণ দেওয়া হয় এবং কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। কনসালটেন্ট নিয়োগের পরে দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং কন্ট্রাকটর নিয়োগ হয়। ২০১৬ সালে কন্সট্রাকশন কাজ শুরু হয়।

মেট্রোরেল নিয়ে জাপানের আগ্রহের শুরুর সময়ে জাইকা সদর দফতরে বাংলাদেশের ডেস্কের পরিচালক ছিলেন ইচিগুচি তোমোহিদে। তিনি বলেন, ওই সময়ে আমি প্রায়শই ঢাকা সফর করতাম এবং বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করতাম। আমি পরে ঢাকায় জাইকা প্রতিনিধি হিসাবে পদায়ন পেয়েছি এবং এখন আমি আমার প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়া দেখছি।

মেট্রোরেল বাংলাদেশের অন্যতম বিরাট অবকাঠামো প্রকল্প এবং এটি সম্পন্ন করা সহজ ছিল না। অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল ভূমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন। এছাড়া ভালো কন্ট্রাকটর নিয়োগ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুবিধাও রয়েছে চ্যালেঞ্জের মধ্যে।

তবে সবচেয়ে বড় যে দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হলি আর্টিজান সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা এবং কোভিড-১৯ মহামারি।

এদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন সরকার দ্রুত এমআরটি পুলিশের অনুমোদন দেবে। হয়তো ২৮ ডিসেম্বরের আগেই এমআরটি পুলিশ গঠনের অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে। অনুমোদন পাওয়ার পরপরই নতুন এই ইউনিট মেট্রোরেলের কাজে যোগ দেবে। এই ইউনিটের প্রধান হিসেবে থাকবেন ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। অনুমোদনের বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে।

উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার মেট্রোরেলে ৯টি স্টেশন থাকবে। এসব স্টেশনে এমআরটি পুলিশ নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করবে।

পুলিশ সদর দফতর বলছে, এমআরটি পুলিশ নামে নতুন ইউনিট গঠনের প্রক্রিয়া বর্তমানে রিভিউয়ের জন্য সচিব কমিটিতে রয়েছে। ইউনিট গঠনের আগ পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা এই ইউনিটের আওতায় এসে কোনও ধরনের কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন না। তবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ যদি পুলিশ সদর দফতরের কাছে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সদস্য চায়, তাহলে সে বিষয়ে সদর দফতর কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।

ইতোমধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সদর দফতরে পুলিশ সদস্য চেয়েছে। কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী সব বিষয় বিবেচনা করে সদর দফতর পুলিশ সদস্যদের সেখানে মোতায়েন করেছে। তবে সংখ্যার বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।

মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিকী মেট্রোরেলের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সদর দফতরের কাছ থেকে যাওয়া পুলিশ সদস্যরা মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) সকাল থেকে মেট্রোরেলের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োজিত রয়েছেন। মেট্রোরেল পুলিশের অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত তারা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, দ্রুত মেট্রোরেল পুলিশ ইউনিটের অনুমোদন পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (ওএনএফ) ফারুক হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল পুলিশ নামে নতুন ইউনিটের অনুমোদন পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সচিব কমিটিতে রয়েছে। সেখানে পর্যালোচনা চলছে। অনুমোদন পাওয়ার পর মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় মেট্রোরেল পুলিশ কার্যক্রম শুরু করবে।

৩৫৭ সদস্যের মেট্রোরেল পুলিশের প্রধান হিসেবে থাকবেন একজন ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা। থাকবেন পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা রাখার জন্যও প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তবে থাকছেন না সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদমর্যাদার কোনও কর্মকর্তা।

এছাড়া পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) পদমর্যাদার সাত জন কর্মকর্তা থাকবেন মেট্রোরেল পুলিশ ইউনিটে। উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার চার জন (নিরস্ত্র) এবং দুজন (অস্ত্র); সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার ৫১ জন (নিরস্ত্র) এবং চার জন (অস্ত্র), নায়েক ১০ জন, কনস্টেবল ২৭০ জন, হিসাবরক্ষক একজন, উচ্চমান সহকারী একজন, কম্পিউটার অপারেটর একজনসহ আরও কয়েকটি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ