Search
Close this search box.
বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপনে জঙ্গিরা

বড় ধরণের নাশকতার পর ভিডিও বার্তায় দায় স্বীকার ছিল মূল টার্গেট

রাকিব হাসান- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের ফলে দূর্গম পাহাড়ি এলাকা ছেড়ে সমতল এলাকায় এসে বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপনে রয়েছেন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া‘র সদস্যরা। চিরুনী অভিযানের কারনে তারা পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে তাদের নিজস্ব তৈরিকৃত ক্যাম্প ছেড়ে পালায়।

এমনটাই জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা। র‌্যাবের উচ্চপদস্থ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গত দুইমাস যাবৎ চলমান র‌্যাবের ধারাবাহিক অভিযানের কারনেই প্রথম দিকে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে আশ্রয় নেয় জঙ্গিরা। চলমান অভিযানের ফলে পাহাড়ে টিকতে না পেরে এখন সমতল সহ পাহাড়ী বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করছে।

জানা গেছে, পাহাড়ে বসেই তারা তাদের অস্তিত্বকে জানান দেয়ার উদ্যেশ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা তৈরি করে আসছিল।সেখানে বসেই অস্ত্র সংগ্রহ, বোমা তৈরি থেকে শুরু করে সামরিক প্রশিক্ষন নেয় জঙ্গিরা। আর তাদের এই কাজে সহযোগীতা করে পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর প্রধান নাথান বম, সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ভাংচুং লিয়ান বম এবং অপর আরেক নেতা মিডিয়া শাখা প্রধান কথিত লেঃ কর্নেল লালজং মুই ওরফে মাওয়াইয়া এবং কথিত লেঃ কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল ওরফে চির চির ময় । নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের সামরিক প্রশিক্ষন,অস্ত্র, খাদ্য সহ যাবতীয় সকল সুবিধা দেয় সেই নাথান বম।

গোয়েন্দা তথ্য মতে, নাথান বম পাহাড়ে নিজ শক্তি বৃদ্ধির জন্য নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে অর্থের বিনিময়ে সহায়তা করে। মূলত পাহাড়ে কেএনএফ বিরোধী শক্তিকে দমনের জন্য জঙ্গিদের সামরিক প্রশিক্ষন, পাহাড়ে চলাচলের কৌশল শেখায় তারা। দেশের বাহির থেকে একটি স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তাদের অর্থায়ন করেছে বলে জানিয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের সাথে দেশে অবস্থানরত স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তাদের অস্ত্র ও বোমা তৈরির সরন্জাম কিনতে অর্থায়ন করে বলে জানা গেছে।

সোমবার নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের নানা মুহূর্তের একটি ভিডিও উদ্ধার করেছে র‌্যাব। ভিডিওতে দেখা গেছে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ, রণকৌশলগত চলাচল, চলতি পথে অস্ত্র বহন এবং টহলকালীন ও কেমন হবে ব্লক করার সময়কার অবস্থান। কোন লক্ষবস্তুতে হানা দেওয়ার সময় কীভাবে ৩৬০ ডিগ্রির কৌণিক দূরত্বে সদস্যরা অবস্থান নেবেন, সেই চিত্র রয়েছে ভিডিওতে।

র‌্যাবের একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ভিডিওগুলো গত সেপ্টেম্বরের আগে তৈরি করা। কোন বিশেষ স্থান বা সরকারী কোন স্থাপনার সামনে বড় ধরনের হামলার পর অস্ত্রসহ এসব ভিডিও প্রকাশ করে দায় স্বীকারের পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের। এরমধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে সোমবার ভোরে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ও তার সহযোগী আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। রনবীরের মোবাইল ফোনেই পাওয়া যায় পার্বত্য অঞ্চলে সংগঠনটির সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও।

র‌্যাব বলছে গ্রেফতারকৃত দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আত্মগোপনে থাকা আরো কয়েজনের মোবাইলেও এধরনের ভিডিও তৈরি করা রেয়েছে বলে জানিয়েছে জঙ্গিরা। এসকল ভিডিও দেখিয়ে তারা আন্তজার্তিক জঙ্গিগোষ্ঠির কাছ থেকে অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।

র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হওয়া ভিডিওতে জঙ্গিদের কয়েকটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দেখানো হয়েছে। সেগুলো হলো- জর্দান ক্যাম্প, ডা. আহমেদ ক্যাম্প, রেতলাঙ ক্যাম্প, রামজুদান পাহাড়ের পাশে রামজুদান ক্যাম্প। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এসব ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছে। ভিডিওর শুরুতেই জামাতুল আনসারের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদকে দেখা গেছে। ঠিক তার পেছনেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) এক প্রশিক্ষককেও দেখা গেছে।

মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে র‌্যাব। ভিডিওতে সামরিক পোশাকের আদলে তৈরি পোশাক পরে একে-২২ রাইফেল ও শটগান নিয়ে প্রশিক্ষণের দৃশ্যধারণ করা হয়। তাতে যে ২২-২৩ জনকে দেখা গেছে, তাদের প্রায় সবার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরমধ্যে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, কথিত সামরিক কমান্ডার শিব্বির আহমেদ ওরফে হামিদ কারছে এবং দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুনকেও দেখা যায়।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, জঙ্গিদের হাতে অস্ত্র, ওয়াকিটকি, কারও মাথায় কাফনের কাপড়। সব তরুণের চোখ-মুখ হাস্যোজ্জ্বল। নিজেরা রান্না করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন ও খাওয়া-দাওয়া করছেন। পাহাড়ে তৈরি বাঙ্কারে কেউ কেউ পাহারা বসান। বিশাল কড়াইয়ে বনের ভেতরে কথিত হিজরতের উদ্দেশে ঘরছাড়া তরুণরা মাংস রান্না করছেন। কোনো তরুণের কাঁধে ভারী অস্ত্র। তারা কাঠের তৈরি ক্যাম্প পাহারা দিচ্ছেন। কারও গায়ে কমব্যাট ড্রেস।

সাব্বির ওরফে কারসে এবং দিদার ওরফে চাম্পাইকে দেখা গেছে ভিডিওতে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সামরিক কার্যক্রম বা প্রশিক্ষণ দুভাগে বিভক্ত ছিল। দুটি ভাগের দায়িত্ব দেওয়া ছিলএ দুজনের উপর। আর পুরো সামরিক কার্যক্রম দেখভাল করতেন গ্রেফতার হওয়া সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান। ভিডিওতে সালেহ ও আল-আমিন নামের আরও দুজনকে দেখা গেছে। গ্রেফতার হওয়া সালেহ কদিন আগে বান্দরবানে শারক্বীয়ার দুই সদস্যের কবরের সন্ধান দিয়েছিলেন।

এই ভিডিও করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে র‌্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আছেন ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করা। সংগঠনটির সামরিক শাখায় যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তাদের করণীয় কী হবে, সে বিষয়টি সামনে রেখেও ভিডিওটি করা হয়েছে। সমতলে অবস্থানকারী বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভিডিও দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করাও ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।

গত সেপ্টেম্বর থেকে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া আটজন তরুণের মধ্যে চারজন ও কেএনএফ সদস্যসহ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বর্তমান আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। উগ্রবাদী এ সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্য রয়েছেন। তারা দাওয়াতি, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন।

এরমধ্যে শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতি শাখার প্রধান, রনবীর সামরিক শাখার প্রধান, মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার সেকেন্ড ইন কমান্ড, মোশারফ হোসেন রাকিব অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীন মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ