স্টাফ রিপোর্টার- নেত্রকোণার কলমাকান্দা এলাকায় ১৯৯৫ সালে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে গণধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আব্দুর রাজ্জাক ওরফে জাকির (৬০) কে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ঘটনার পর থেকে গত ২৮ বছর ধরে পলাতক ছিলেন তিনি। গাজীপুরের গাছা থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩ এর একটি দল।
র্যাব বলছে, ২৮ বছর পলাতক জীবনে গ্রেফতার এড়াতে রাজ্জাক কখনো রিকশা, কখনো সিএনজি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরে নাম পরিবর্তন করে রাজ্জাকের পরিবর্তে জাকির নামে করেন নতুন এনআইডি।
রবিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলিতে র্যাব-৩ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত রাতে র্যাব-৩ এর একটি বিশেষ দল নেত্রকোণার কলমাকান্দা থানাধীন এলাকায় ১৯৯৫ সালে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে গণধর্ষণপূর্বক হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং ২৮ বছর ধরে পলাতক প্রধান আসামি আব্দুর রাজ্জাক ওরফে জাকির হোসেন (৬০) কে গাজীপুরের গাছা থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। তিনি নেত্রকোণার কলমাকান্দার মৃত মফিজ উদ্দিনের ছেলে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে র্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, আব্দুর রাজ্জাক নেত্রকোণার কলমাকান্দা থানার হাপুনিয়া গ্রামে তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সপরিবারে বসবাস করতেন। তিনি বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য চলছিল। একপর্যায়ে তার স্ত্রী পারিবারিক কলহ এবং রাজ্জাকের বেপরোয়া চলাফেরার জন্য সন্তানসহ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন।
স্ত্রী-সন্তান থেকে পৃথক হওয়ার ফলে তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আরও বেড়ে যায়। একই গ্রামের একদল বখাটে যুবককে সঙ্গে নিয়ে তিনি এলাকায় গুম, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন। রাজ্জাক তার প্রতিবেশী রুস্তম আলীর কিশোরী মেয়েকে কুপ্রস্তাব দেন। এতে সে রাজি না হলে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার এবং হত্যার হুমকি দেন। এতেও কাজ না হলে ১৯৯৫ সালের ১৩ এপ্রিল দুপুরে আজিজ, আলাল, আব্দুর রব, শাহিদ মিয়া, রহমান এবং হান্নানসহ বেশ কয়েকজন মিলে কিশোরী হেলেনাকে অপহরণ করে পাউরা গ্রামের একটি হাওরে নিয়ে যান।
পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সেখানে ১২ জন মিলে ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করেন। একপর্যায়ে কিশোরীকে শ্বাসরোধে হত্যা করে হাওরের ধান ক্ষেতে লাশ বস্তাবন্দি করে মাটিতে পুতে রেখে পালিয়ে যান তারা। নিখোঁজ কিশোরীর সন্ধান না পেয়ে বাবা রুস্তম আলী আসামি আব্দুর রাজ্জাকসহ কয়েকজনের নামে একটি অপহরণ মামলা করেন। ওই ঘটনার ছয় দিন পর ১৯৯৫ সালের ১৯ এপ্রিল ভোরে কিশোরীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মরদেহ শনাক্ত করার পর ১৯ ফেব্রুয়ারি কলমাকান্দা থানায় আব্দুর রাজ্জাককে প্রধান আসামি করে মোট ১০ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণসহ হত্যা মামলা করেন কিশোরীর বাবা। পরে তদন্তে ১০ জন আসামিসহ আরও দুজনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বের হয়ে আসে। ২০০২ সালে আদালত বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে হত্যাসহ ধর্ষণের অপরাধে রাজ্জাকসহ পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর সাত আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
১২ জন আসামির মধ্যে দুজন গ্রেফতারের পর জেলহাজতে মৃত্যুবরণ করেন। আট জন বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন এবং একজন পলাতক ছিলেন।
গ্রেফতার রাজ্জাক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এবং তিনি মূলত কৃষিকাজ করতেন। ১৯৯৫ সালে ঘটনার পরপর তিনি নিজ এলাকা নেত্রকোণা থেকে পালিয়ে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় এসে কিছুদিন রিকশাচালক হিসেবে আত্মগোপন করেন।
এখান থেকে পালিয়ে তিনি সপরিবারে উত্তরায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে আত্মগোপন করেন এবং সিএনজি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখানে ছয় বছর থাকার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়ে তিনি পুনরায় স্থান পরিবর্তন করে গাজীপুরের গাছা থানা এলাকায় গা ঢাকা দেয়।
সেখানে গিয়ে তিনি নাম পরিবর্তন করে জাকির হোসেন ছদ্মনাম দিয়ে এনআইডি ইস্যু করেন এবং দাড়ি ও চুল বড় রেখে নতুন পরিচয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এসময় তিনি দুটি সিএনজি কেনেন, একটি নিজে চালাতেন এবং আরেকটি ভাড়া দিয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
এছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিভিন্ন মাদকের চালান সংক্রান্ত কাজেও সম্পৃক্ততার কথা জানান। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাবের এই কর্মকর্তা।