টি এম মামুন, বগুড়া : কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ডাকা হরতালে শহরের নবাববাড়ী সড়ক ও উপজেলা সদরের গোকুল খোলারঘর এলাকায় পুলিশের গুলিতে শিশু শিক্ষার্থীসহ কমপক্ষে ৭ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া হরতালের সমর্থনে বিএনপি এবং বিপক্ষে আওয়ামীলীগ এর মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় সংঘর্ষে আহত হয়েছেন পুলিশসহ আরও কমপক্ষে ২০ জন।
যদিও প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনরকম তথ্য জানানো হয়নি স্থানীয় সাংবাকিদের। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে বগুড়া সদর উপজেলার বাঘোপাড়া খোলারঘর এলাকার আব্দুর রবের ছেলে মহিউদ্দিন মাহি (৮), মাকসুদুরের ছেলে আওলাদ (১৫) নয়ন, রাজু, ও গফুরের নাম জানা গেছে। আহতদের মধ্যে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র ১৫ নেতাকর্মি রয়েছে বলে দাবি উভয় পক্ষের নেতাদের।
পথচারী ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, সকাল থেকেই র্যাব-১২ বগুড়া কার্যালয় এবং জেলা পুলিশের একাধিক টিম ছিল সতর্কাবস্থায়। সকাল ৭ টার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আকতারের নেতৃত্বে সাতমাথায় জিলা স্কুল সংলগ্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক পুলিশ এবং প্রায় একই সময় র্যাব-১২ বগুড়া ক্রাইম প্রিভেনশন স্পেশাল কোম্পানির অধিনায়ক পুলিশ সুপার মীর মনির হোসেনের নেতৃত্বে শহরে সশস্ত্র মহড়া দেন র্যাব সদস্যরা।
হরতালের সমর্থনে রবিবার সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে শহরের নবাববাড়ী সড়কে জেলা বিএনপির কার্যালয় থেকে কিছু নেতাকর্মিরা মিছিল বের করেন। সামান্য এগুতে সদর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে মিছিলে বাধা দেয় পুলিশ। বাধা অতিক্রম করে মিছিল শপিং মল ‘রানার প্লাজা’ র দিকে এগোনোর চেষ্টা করলে পুলিশ বেশ কয়েকরাউন্ড শর্টগানের গুলি ছুড়ে নেতাকর্মিদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে নেতাকর্মিরা ফতেহআলী বাজারের সামনে ও গালাপট্টি সড়ক মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় একাধিক ককটেল বিস্ফোরনের শব্দ পাওয়া যায়। পুলিশ তখন গালাপট্টি মুন হোমিও হলের সামনে মোড়ে অবস্থান নেয়। হরতালকারীরা সকাল থেকেই নানা কৌশলে উপজেলা শহরের চেলোপাড়া, কলোনী, খান্দার, বাদুরতলা, বৌবাজার, সদরের বারপুর, মাটিডালিসহ বগুড়া-ঢাকা, বগুড়া-নাটোর, বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের বনানী, শাকপালাসহ শহরের প্রবেশপথে যানবাহন চলাচলে বাঁধা দেন। হরতাল চলাকালে শহরের অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস, ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচল করেনি। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ব্যাংক ও বীমা অফিস খোলা থাকলেও মানুষের উপস্থিতি অন্যদিনের তুলনায় ছিল অনেক কম।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পথচারী জানান, পুলিশের মারমুখি আচরণ এবং আওয়ামীলীগ দলীয় কার্যালয় থেকে কতিপয় নেতাকর্মির উস্কানী মূলক বক্তব্যের কারণে মিছিলে অংশ নেওয়া বিএনপি নেতাকর্মিরা আওয়ামীলীগ কার্যালয়ের সামনে এসে তাদের উপর চড়াও হয়। এ সময় আওয়ামীলীগের কয়েকজন আহত হন। এরপর আওয়ামীলীগ নেতাকর্মিরা সংগঠিত হয়ে পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মিদের ধাওয়া করে। এ সময় একজন পুলিশ সদস্যসহ বিএনপি’র ৮/১০ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন। এদের মধ্যে স্থানীয় দৈনিক জয়যুগান্তরের ফটোগ্রাফার সাব্বির শাকিল ডিবি (গোয়েন্দা) পুলিশের দুই সদস্য ইসমাইল ও মোস্তাফিজুর নাম শেনা গেছে।
বেলা ১২ টার দিকে হরতাল সমর্থন পরিচয়ধারীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’র (ইউএনও) গাড়ি ভাংচুর করে। সংবাদ পেয়ে বগুড়া সদর থানা ও ডিবি পুলিশের পৃথক টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছিলে তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে হরতাল সমর্থকরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শর্টগানের গুলি ছুড়লে শিশু শিক্ষার্থী মাহি, নয়ন, রাজু, আওলাদ ও গফুর ও ৫ হরতাল সমর্থক আহত হয় পুলিশের গুলিতে। শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শতশত গ্রামবাসী মহাসড়ক অবরোধ করে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। জনতা একতাবদ্ধ হলে পুলিশ সদস্যরা কিছুটা পিছু হটে।
টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিদর্শক তানজিলা আক্তার বুলবুলি বলেন এবং টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিকেল কর্মকর্তা মেহেদী হাসান জানান, গুলিবিদ্ধ ৭ জনকে এখানে আনা হয়েছিল। এদের মধ্যে ৬ জনের হাত ও পা থেকে গুলি বের করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এক শিশুর চোখে গুলিবিদ্ধ থাকায় সে গুরুতর জখম অবস্থায় আছে। তাকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দুপুরে বগুড়া জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি মাফতুন আহমেদ রুবেল এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ উন নবী সালাম খান অভিযোগ করেন, পুলিশ বিনা উসকানিতে প্রথমে ৮/১০ বছরের শিশুর ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়েছে। এরপর উত্তেজিত হয়ে গ্রামবাসী মহাসড়কে অবস্থান নিলে পুলিশ বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে।
বগুড়ায় কোন হরতাল হয়নি উল্লেখ করে জেলা আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান রনি জানান, বিএনপি নেতাকর্মিরা অকারণে তাদের উপর হামলা চালিয়ে জেলা আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক আল রাজী জুয়েলসহ কমপক্ষে ৭ নেতাকর্মিকে জখম করেছে হরতালকারীরা। বগুড়া ডিবি পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তাফিজ হাসান দাবি করেন, প্রথমে হরতালকারীরা আমাদের সদস্যদের ওপর হামলা করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুলি করতে বাধ্য হয়েছে।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা বলেন, রবিবারের হরতালে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল। শহরে বিএনপির সমাবেশ চলাকালে সরকারি দলের গুন্ডারা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে হাতবোমা গুলি চালিয়ে তাদের উপর অন্যায় ভাবে হামলা করেছে। পুলিশের গুলিতে তাদের কমপক্ষে ১৫ নেতাকর্মি আহত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিরীহ গ্রামবাসীর উপর গুলি চালিয়ে পুলিশ পেশাদারিত্ব ভূলে গিয়ে আওয়ামীলীগের গুন্ডা হিসেবে পরিচিত করেছে নিজেদের।
এর আগে হরতালকে পুজি করে কারণ ছাড়াই শতাধিক নেতাকর্মিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম পুলিশের গুলি করার বিষয়টি স্বীকার করলেও তারা কী পরিস্থিতিতে কত রাউন্ড গুলি ছুড়েছে, তা জানাতে পারেননি। তবে প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী কোন ফোন রিসিভ করেননি।