প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল শনিবার (১১ নভেম্বর) কক্সবাজারে নব নির্মিত আইকনিক স্টেশনে এই রেলপথ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এর জন্য নেওয়া হয়েছে সব প্রস্তুতি। কক্সবাজার শহরের ঝিলংজায় ঝিনুকের আদলে তৈরি এশিয়ার সর্ব বৃহৎ আইকনিক রেল স্টেশনকে সাজানো হয়েছে মনোরম ভাবে। এখানে যাত্রা শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে নতুন ট্রেন। একুশটি বগির নতুন ট্রেনটি বুধবার কক্সবাজারে পৌঁছেছে।
এর আগে রোববার পর্যটন শহর কক্সবাজারে প্রথম পৌঁছে আরও একটি ট্রেন। যে ট্রেনটি চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে কক্সবাজার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল পরীক্ষামূলকভাবে। মূলত উদ্বোধনের আগে প্রকল্পটি রেল চলাচলের উপযোগী কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ট্রেনটি যাত্রা করেছিল। এটির সফল যাত্রার পর বুধবার কক্সবাজার পৌঁছে নতুন বগি সংযুক্ত আরও একটি ট্রেন। আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী এই ট্রেনে চড়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বহুল প্রতিক্ষিত রেল লাইন প্রকল্পের।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ট্রেন পথ
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ট্রেন পথ ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে দোহাজরি পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার পথ বৃটিশ আমলে তৈরি। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেয় বর্তমান সরকার। এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার বিবেচনায় গৃহীত একটি মেগা প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় সংস্কার করা হয়েছে শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন জানান, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে মেগা প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মেগা প্রকল্পে ১০২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। যার অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
প্রকল্পে যা আছে
দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হয়েছে। রেলপথে স্টেশনের সংখ্যা থাকছে নয়টি। এগুলো হলো—সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়ার সাহারবিল, ডুলাহাজারা, ঈদগাও, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও ঘুমধুম। এতে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম থাকবে নয়টি, ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম থাকবে নয়টি। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। এ ছাড়া ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট, সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় একটি ফ্লাইওভার, ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং এবং রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং রয়েছে।
মনোমুগ্ধকর আইকনিক রেলস্টেশন
কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে আইকনিক রেল স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এই স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয় তলা ভবনটির কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। আইকনিক রেল স্টেশন দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছে বিপুল সংখ্যক মানুষ।
রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন গতকাল বৃহস্পতিবার ও আজ শুক্রবার কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প এবং আইকনিক স্টেশন ভবন পরিদর্শন করেছেন। প্রকল্পের উদ্বোধন সম্পর্কে তিনি সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনাও প্রদান করেছেন।
রেলমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারে ট্রেনে করে আসার জন্য সারাদেশের মানুষ ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে। এই রেল পথ পর্যটন শিল্পে আমুল পরিবর্তন আসবে।
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের সকলের জন্য গর্বের একটা বিষয় কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন বিল্ডিং। এরকম অনন্য স্থাপনা অন্য কোথাও নেই। ঝিনুকের আদলে তৈরি স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদি ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারাদিন সমুদ্র সৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারবেন।’
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার আবদুল জাবের মিলন বলেন, সমুদ্র সৈকত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা এলাকায় ২৯ একর জমিতে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্টেশন। আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালি সহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছে। চার বছরের শ্রমে অনন্য সুন্দর রেলস্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান।
মিলন বলেন, এই স্টেশন হবে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলা স্টেশন। এতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকরা যেন কক্সবাজারে দিনে এসে ঘুরে আবার ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। এ ছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকেট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, লকারসহ নানা সুবিধা। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিন তলায় থাকবে তারকা মানের হোটেল। থাকছে মসজিদ, শিশু যত্ন কেন্দ্র ও চলন্ত সিঁড়ি। এখনে থাকছে এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ সহ নানা সেবা কেন্দ্র।
বদলে যাবে কক্সবাজার
হাজারো লোক প্রতিদিন কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশনে দেখতে আসছে। রেল স্টেশনে কথা হয় শিক্ষক শফিউল আলম এর সঙ্গে। তিনি স্থানীয় পোকখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কক্সবাজারে ট্রেন আসায় উচ্ছ্বসিত শিক্ষক শফিউল আলম। তিনি বলেন, ‘স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আমার বাপ-দাদারা ট্রেনে চড়ে ঢাকা চট্টগ্রাম যায়নি। এখন আমি ও আমার সন্তানরা ট্রেনে চড়ে যাব। এটা অনেক আনন্দের।’
কক্সবাজার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, ‘স্বপ্নের রেল এখন পর্যটন শহর কক্সবাজারে। এই রেল পথ বাংলাদেশের উন্নয়নে যুগান্তকারী ঘটনা। বৃটিশ, পাকিস্তানের সুদীর্ঘ সময় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশত বছরে যা হয়নি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার তা করে দেখালেন। ’
তার দাবি, এই রেল পথ কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে পরিপূর্ণতা দেবে। বিদেশি পর্যটক আনতে সহায়ক হবে। শুধু শীতকালে নয়, বর্ষা সহ সারা মৌসুম পর্যটকরা কক্সবাজার ভ্রমণে উৎসাহিত হবে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক সুবক্তগীন বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার নতুন রেলপথ প্রকল্প শনিবার (১১ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। এজন্য সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে ১০২ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানো হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ এবং আন্ডারপাস সহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক স্টেশন সহ নয়টি স্টেশনের নির্মাণ কাজ শেষ। এ ছাড়া চুনতি এলাকায় একটি আন্ডারপাসের ওপর দিয়ে হাতি চলাচলের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।