০১. ক্ষত
নীলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ কর্মসৃত্রে। বেশ নাক উঁচু ভাব! কাজকর্মে, বিদ্যাবুদ্ধি ও সৌন্দর্যে নিজেকে অতুলনীয় বলে মনে করতো সবসময়। গোড়ায় সম্পর্কটা ওর সঙ্গে পোশাকি হলেও ধীরে ধীরে তা গাঢ় হয়ে ওঠে। সরল মনে পেট-ছেঁচে যতটা আমি আমার কথা উগরে দিতাম, ও এর উল্টোটা করতো। অর্থাৎ কিছু ঢেকে, কিছু বলে। আমার বন্ধুমহল থেকে বাড়ি অব্দি অবাধ যাতায়াত ছিলো ওর। আমাদের বাড়িতে সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা চলছিলো বেশ ক’দিন ধরে। নীলাও তা জানতো।
এ জটিলতায় আমাদের বাসায় ও সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে হুলস্থূল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছিলো রীতিমতো। বাবা হার্টের রোগী। এই ধকল নিতে পারলেন না। হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো ওনাকে। ডাক্তার জানালেন, হার্ট অ্যাটাক করেছেন। এখন থেকে সাবধানে রাখতে হবে রোগীকে। যেখানে সম্পত্তি সেখানেই যত রেষারেষি আর মারামারি। মাথার ওপর বটবৃক্ষের মতো এতদিন যিনি আগলে রেখেছিলেন, সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে বাবা হঠাৎ চিরতরে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
নীলার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখন বেশ চমৎকার। যখন তখন বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে যাই আমরা। আমার বাসায় আগের মতোই অবাধ যাতায়াত ওর। হঠাৎ একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো,’ দেখতে দেখতে তোমাদের পরিবারটা ভেঙ্গে কেমন যেনো হয়ে গেলো! ভাবলেই আমার ভীষণ কষ্ট হয়, শারমিন!’ মুহুর্তেই অন্যমনস্ক হয়ে যাই আমি। হঠাৎ আমার কী যে হল, কে জানে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই, সাৎ করে ওর চুলের মুঠি ধরে বসলাম আমি। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে ঘাড়টাকে কাত করে চোখে চোখ রেখে বললাম,’ তোর অনেক হুজ্জতি সহ্য করেছি। তুই আমার কিসের বন্ধু? নিমক হারামের সাথে বন্ধুত্ব হয় কখনো! গায়ে অনেক তেল হয়েছে না তোর, সব তেল নিংড়ে নিবো বুঝলি। এরপর তা বোতলে ভরবো, সেই তেল আবার তোকেই গেলাবো! সাবধানে থাকিস। বুঝেছিস হারামি!’ রাগে ঘেন্নায় নীলার মুখে একদলা থুথু ছিটিয়ে, হেঁচকাতে হেঁচকাতে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলো শারমিন!
২. ধূসর অর্কিড
অনেকদিন ধরেই কিডনী রোগে ভোগছেন রাশেদ চৌধুরী। পঞ্চাশে পা রাখতে না রাখতেই ধরেছে এ মরণব্যধি। বেশ কয়েকবার বেলোরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছেন। প্রথমদিকে বেশ শক্ত সমর্থ ছিলেন। ঘুরে বেড়াতেন যেখানে সেখানে। সময়ের সাথে সাথে রোগও জটিল রাস্তায় বাঁক নিয়েছে! ডায়েট থেকে বাদ পড়েছে প্রোটিন, আছে কেবল গোটা চারেক সবজি। পেটানো শরীর কয়েক বছরের ব্যবধানে পাখির ছানায় রূপ নিয়েছে! শুকনো চামড়া দোপাট্টার মতো কোনভাবে পাঁজরকে ঢেকে রেখেছে যেনো!
‘আর কতদিন এই লাউ সেদ্ধ খেয়ে যাবো, বলতে পারিস? আলুনো! এ অখাদ্য কী মুখে রোচে!’ রাগে-দুঃখে কথাটি মেয়েকে শুনিয়ে শিশুর মতো কনুইয়ে চোখ মুছতে থাকেন তিনি। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে নাতি এটা ওটা নিয়ে আসে। আর তা খেয়েই এর মধ্যে হুলস্থুল কান্ডও বেঁধে গেছে শরীরে ! পটেটো চিপস, বাদাম, চানাচুর এখন ওনার ঘর অব্দি ঢোকা পুরোদস্তুর নিষেধ।
এখন ইউটিউবে রান্নার অনুষ্ঠানের রসাস্বাদন নিতে নিতে, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েন রাশেদ সাহেব নিজেও টের পান না!
৩. হলদে বেনেবউ
– হাই
– হাই
– কেমন আছেন?
– ভালো আছি, আপনি?
– কি করছেন? আমি ব্যবসা। আপনি?
– গান শুনি। স্কুলে পড়াই।
রাত বাড়ছে, কথাও বাড়ছে সমানতালে। রাত সাড়ে তিনটে। ভোর হবে হবে করছে। কাজেকর্মে ভজঘট অবস্থা! দিলখুশ মেজাজ। ঘরের ভেতর উড়তে থাকা তেলাপোকাকেও প্রজাপতি ভেবে বিভ্রাট হয় আজকাল। বোলতার চাককেও মনে হয় গোলাপের সাজি। যেনো ভুরভুর করে সুগন্ধি ছড়াচ্ছে!
মাস ছয়েক পর।
ফেইসবুক মেসেঞ্জার অফলাইন, মানে সবুজ বাতি উধাও। পোষ্টের ছড়াছড়ি নেই আগের মতন! স্কুল টিচার মেসেঞ্জারে নক করে যান প্রতিদিন। ও প্রান্তের সাড়া শব্দ নেই! কাজকর্ম আগের চাইতও হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সেই উৎফুল্লতাও নেই আর!
কিছুদিন পর।
আবার প্রাণোচ্ছলতা ফিরে এলো যেনো স্কুল টিচারের মাঝে। কাজেও ছন্দ ফিরে এসেছে। সুশোভিত আভাস দেখতে পান পচা গলা নর্দমা থেকে শুরু করে বিরক্তিকর যানজটেও।
আরও কিছুদিন পর।
আবার ব্রেকআপ। এখন সবকিছুকে আলুভাতে বলেই মনে হয় তার কাছে!