রাঙামাটি প্রতিনিধি: পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত কৃষকদের জীবিকা চলে জুম চাষে। আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা ও নানা প্রতিকূলতার কারণে জুমসহ কৃষি কাজে আগ্রহ হারাচ্ছে পাহাড়ের কৃষকরা। এর মধ্যে যারা কৃষিনির্ভর জীবন ধারণ করছে তাদের এসব সমস্যা ও প্রতিকূলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে, দিন দিন পাহাড়ের জুমিয়াদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা।
পাহাড়ে চৈত্র-বৈশাখে আগুন দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কারের মাধ্যমে শুরু হয় জুম চাষের প্রাথমিক প্রক্রিয়া। এরপর শুরু হয় জমি প্রস্তুতিকরণ প্রস্তুতি। বর্ষার শুরুতে পাহাড়ের বুকে চলছে বীজ বপন। ঢালু জমিতে দা দিয়ে গর্ত করে সেখানে ফেলা হচ্ছে ধান, হলুদ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ। যেগুলো সময়ের পরিক্রমায় বড় হয়ে একসময় ফসলে ভরে উঠবে। তবে জমি সঙ্কটসহ আরো বিভিন্ন সমস্যায় অনেক জুমিয়া এখন জুম চাষ ছেড়ে ফল বাগান সৃজনে ঝুঁকে পড়ছে। সাধারণত ৩-৫ বছর পাহাড়ের গায়ে কিছু স্থানে চাষ করে সেই স্থানকে উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য রেখে দিয়ে আবার পাহাড়ের অন্য স্থানে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করা হলেও বর্তমানে জমি সঙ্কটে সেই সুযোগ কমে এসেছে। বার বার একই স্থানে চাষাবাদ করতে থাকায় কমেছে জমির উর্বরতা। প্রয়োজন পড়ছে অতিরিক্ত সারের। পাশাপাশি রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতাসহ ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়া। এতে জুম চাষের প্রতি আগ্রহ কমছে কৃষকদের।
রাঙামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের বাসিন্দা সুবিমল চাকমা। পাহাড়ের জমিতে জুম চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও জুম চাষের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বর্তমানে জুম চাষাবাদ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, জুম চাষ করে এখন আর আগের মতো ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশি বেশি সার দিতে হয়, কীটনাশক দিতে হয়, তারপরও ফসল ভালো হয় না। প্রায় ফসলের গাছই মরে যায়। তাই আগামী বছর থেকে ফলের বাগান করব।
একই ইউনিয়নের বাসিন্দা শিখা চাকমা বলেন, একে তো সারের দাম বেশি এবং সার জমি পর্যন্ত আনতে অনেক টাকা খরচ হয়, সারও বেশি লাগে। মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ায় আদা হলুদ এসব গাছের পাতা হলুদ হয়ে মরে যায় ইদানিং। তাই জুম চাষ করে এখন লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি।
রাইন্যা টুগুন ইকো ট্যুরিজমের উদ্যেক্তা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) এর সাধারণ সম্পাদক ললিত সি. চাকমা জুমের আধুনিকীকরণের পাশাপাশি জুমের উপযোগী বীজ উদ্ভাবনের তাগিদ দিয়ে বলেন, জুম একটি ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি। বছরের পর বছর পাহাড়ের কৃষকরা এটি চর্চা করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে এটিকে আধুনিকীকরণ এবং জুমের উপযোগী বীজ উদ্ভাবনের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণার দরকার আছে।
তিনি আরো বলেন, ফলের বাগান কখনোই জুম চাষের বিকল্প হতে পারে না। কারণ, মানুষ সরাসরি ফল খেয়ে বাঁচে না। জুম থেকে উৎপাদিত অর্থকরী ফসলগুলো কৃষকরা ভোগ করার পাশাপাশি বিক্রিও করে। কিন্তু ফলের বাগান করলে সেগুলো বাজারজাতকরণের প্রয়োজন হবে। যা পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিবেচনায় ব্যয়সাধ্য বলে আমি মনে করি।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, জুম চাষে পাহাড়ের মাটি আলগা করতে হয়। বর্ষাকালে বৃষ্টির সঙ্গে সেই মাটি ধুয়ে এসে কাপ্তাই হ্রদে পতিত হওয়ার ফলে বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের গভীরতা অনেক কমে গিয়েছে। জুম চাষের ফলে মাটির ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়। এই কারণে আমরা চাষীদের জুম চাষে নিরুৎসাহিত করছি। আর যদি জুম চাষ করতেই হয় তবে সেখানে যাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটানো হয় সেই ব্যাপারে পরার্মশ দিচ্ছি। মাটির ক্ষয়রোধসহ বিভিন্ন সমস্যা এড়াতে জুমের আধুনিকীকরণের পাশাপাশি ফল বাগানও সৃজন করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত অর্থবছরে রাঙামাটিতে ৪ হাজার ৬৮৯ হেক্টর জমিতে ধান, ৩ হাজার ৪২ হেক্টর জমিতে আদা ও ২ হাজার ৮৯ হেক্টর জমিতে হলুদ চাষ করা হয়েছে।