রুপম আক্তার: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর গত কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণে বাড়ছে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ তিস্তা নদীর অববাহিকার উজানের অংশে ভারী বর্ষণ হলে তার প্রভাব সরাসরি এসে তিস্তায় পড়ে। গত ১২ জুন থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিকিম রাজ্যে এবং তিস্তার উজান সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হচ্ছে। ফলে বেড়েছে তিস্তা নদীর পানি।
৩ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৫৩ মিটার, যা বিপৎসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে, দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। একের পর এক প্লাবিত হচ্ছে নদ-নদী সংলগ্ন উত্তর জনপদের ব্যাপকাংশের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল। আকস্মিক বন্যার মুখোমুখি রয়েছে উত্তরাঞ্চলের ৪টি জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম।
উত্তর-পূর্ব ভারতে অতিবর্ষণ ও বন্যায় এবং বাঁধ-ব্যারাজ খুলে ‘অকাতরে’ পানি ছেড়ে দেয়ায় উজান থেকে ভারতের ঢলের পানি হু হু করে নেমে আসছে। সেই সাথে বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে টানা অতি বৃষ্টিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে নদ-নদীর পানি।
তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিমে। উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে এ নদীর পানি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বর্ষাকালে পানির চাপ বাড়ার ফলে ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেয় তারা। যার ফলে আমাদের দেশে নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুম এলে সব গেট বন্ধ করে দেয় ভারত। ফলে পানি সঙ্কটে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়, নদীর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী ব্যাপক সঙ্কটে পড়ে। নৌপথে ব্যবসা-বাণিজ্যও বাধার সম্মুখীন হয়।
বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় উজানে ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে তাদের অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশ অংশে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এই উজানের ঢলে তিস্তার পানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকদিনের টানা ভারী বৃষ্টিপাত। ফলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দিকে এগিয়ে আসছে।
বর্ষা শুরু হলেই বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায় ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ। এবারও সেই কাজটিই করা হচ্ছে। টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢেউয়ের কারণে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে চরাঞ্চলের সড়ক পথ।
তিস্তা ব্যারাজ বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ ৩ জুলাই সকাল ৬টায় ছিল ১৭ সেন্টিমিটার নিচে, ৯টায় ছিল ১৯ সেন্টিমিটার নিচে ও দুপুর ১২টায় ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ মিলিমিটার।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বলেন, নদ-নদীর পানির খবর সার্বক্ষণিক নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে নদী তীরবর্তী এলাকার খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সেখানে আরও কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ অবস্থায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করছে রাজ্যটি। বন্যার কারণে রাজ্যটির ১৯ জেলার প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
আসাম রাজ্য সরকার সূত্র বলছে, টানা বৃষ্টির কারণে বিপত্সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে ব্রহ্মপুত্র, বুড়িডিহিং, সুবনসিরি, ধানসিঁড়ি, জিয়া ভরালি, পুথিমারি, বেকি, গুরুং, সঙ্কোশসহ বিভিন্ন নদী। কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের বিস্তীর্ণ অংশ এরই মধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। আসামের বিশ্বনাথ, কাছাড়া, চড়াইদেহ, দারং, চিরাং, ধেমাজি, ডিব্রুগড়, গোলাঘাটা, জোরহাট, কামরূপ, লখিমপুর, শিবসাগর, সোনিতপুর, মরিগাঁও, নগাঁও, মাজুলি, করিমগঞ্জ, তামুলপুর, তিনসুকিয়া, নলবাড়ি জেলার অবস্থা শোচনীয়।
এ বছর বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। তিস্তা বাঁধের সমস্যা ও অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিচ্ছে। এই বন্যার ফলে দেশের অর্থনীতি, কৃষি, এবং মানুষের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।