স্টাফ রিপোর্টার: দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। নদ-নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীর পানি কমছে। তবে পানির কমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত জ্বর-সর্দি, কাশি, ডায়েরিয়া ও চর্ম রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। আসন সংখ্যার তিনগুণ রোগীদের সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।
তবে রোগীদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত ওষুধ রোগীরা পাচ্ছেন না। রোগীর এসব অভিযোগ স্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা বলছেন, যে পরিমাণ রোগী সে পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ নেই। তারা ওষুধ সরবরাহের তাগিদ দেন।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুমিল্লা সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি রাখলেও চর্ম রোগী ভর্তি করানো হচ্ছে না। সেজন্য কুমিল্লা সদর হাসপাতালে বর্হির্বিভাগে শত শত রোগী ভিড় করছেন। সিভিল সার্জন বলছেন, কুমিল্লার ১৪ উপজেলার বন্যায় কবলিত ১২৫টি ইউনিয়নে ২০৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে স্বাস্থ্যসেবায়।
জানা যায়, গোমতি নদীর পানি বিপদসীমার ৩৭১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর এরই মাঝে ভেসে উঠতে শুরু করেছে বন্যার ক্ষত। এবারের বন্যায় কুমিল্লায় ১৪ উপজেলায় প্লাবিত কৃষিখাত, মাছের ঘের, প্রাণিসম্পদ, রাস্তাঘাট ও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মিলিয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী সরকারি হিসেবে কুমিল্লাজুড়ে অন্তত ৩২ হাজার ৬২ কোটি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩৮ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার বুড়িচং উপজেলায় ৫৫৬ কোটি ১৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫৪৩ টাকা।
১৪ জেলায় ১০১ মৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর বন্যায় বিভিন্নভাবে সবচেয়ে বেশি ২০ জনের প্রাণহানি হয়েছে কুমিল্লা জেলায়। এরপর ফেনী জেলায় ১৫ জন, নোয়াখালী জেলায় ১১ জন, মৌলভীবাজার জেলায় ১০ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯ জন, কুড়িগ্রাম ও জামালপুরে সাতজন করে, চট্টগ্রাম, সিলেট গাইবান্ধায় ৫ জন করে, কক্সবাজার ও লক্ষ্মীপুরে তিনজন করে এবং লালমনিরহাটে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে, ডায়রিয়ায় মারা গেছে চারজন, আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এবং সর্পদংশনে মারা গেছে তিনজন, বজ্রপাতে দুজন, অন্যান্য কারণে ১৮ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ বলেন, ‘বন্যায় নানাভাবে পানি দূষণযুক্ত হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় হলো, বন্যাকবলিত এলকায় সুপেয় ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা। কেউ যেন কোনোভাবে দূষণযুক্ত পানি পান না করে সেটিসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত করা গেলে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সহজ হবে।’
তিনি বলেন, ‘যে কারণেই ডায়রিয়া হোক না কেন, ওআরএস ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে হবে। যাতে কোনো ডায়রিয়া রোগী ওআরএসের (স্যালাইন) কারণে পানিশূন্য হয়ে মৃত্যুবরণ না করে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই সময় শিশু, গর্ভবতী নারী ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ অসংক্রামক রোগে ভোগা রোগীর দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কারণ এরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে।’
রোগী বেশি যে ৬ জেলায়
বন্যাকবলিত ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় ডায়রিয়া ও চর্মরোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সর্বশেষ তথ্য মতে, ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ১৮ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে আক্রান্ত ১৮৬ জন রোগী, নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ২০ শয্যার বিপরীতে ২৪৮ জন রোগী ও লক্ষ্মীপুর জেনারেল হাসপাতালে ১০ শয্যার বিপরীতে ৯৫ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।
ধারণক্ষমতার ১১ গুণ বেশি রোগী আসায় সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক, নার্সসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এর মধ্যে ২৫০ শয্যা ফেনী জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের মেঝে ও বারান্দায় রোগীদের ঠাঁই না হওয়ায় হাসপাতালের সামনের রাস্তা ও গাছের নিচে সেবা দেওয়া হচ্ছে অনেক রোগীকে।