Search
Close this search box.

ইসলামের প্রচারে সুফিবাদের ভূমিকা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

ইসলামের প্রচারে সুফিবাদের ভূমিকা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান

বাংলাদেশে ইসলামের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বহু স্তরবিশিষ্ট। এ অঞ্চলে ইসলামের প্রবেশ এবং তার বিস্তারে সুফিবাদের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সুফিবাদ হলো ইসলামের আধ্যাত্মিক ও নিগূঢ় চর্চা, যা মূলত আল্লাহ প্রেম, মানবিকতা এবং আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেয়। ইসলামের প্রচারকালে সুফিগণ কেবল ধর্মীয় শিক্ষার বাহক ছিলেন না, তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন গড়ে তোলার মাধ্যমেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলার  জনপদে সুফিদের এই প্রভাব আজও গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।

বাংলাদেশে ইসলামের প্রথম প্রচার হয় আনুমানিক অষ্টম ও নবম শতকে, যখন আরব বণিকরা বাংলার উপকূলে বাণিজ্য করতে আসেন। তবে ১৩০০ শতাব্দী থেকে ইসলামের মূলধারা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে, যার অন্যতম চালিকাশক্তি ছিলেন সুফি সাধকরা। পারস্য, মধ্য এশিয়া এবং আরব দেশ থেকে আগত সুফি সাধকরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আধ্যাত্মিক চর্চা, শিক্ষা এবং মানবিকতার বার্তা প্রচার করেন।

তারা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সহজ-সরল মানুষকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছিলেন। সুফিবাদের মূল শিক্ষা ছিল আল্লাহর সঙ্গে গভীর প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং মানব সেবা করা। এ ধরনের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধ এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। সুফিগণ সাধারণ মানুষের সরাসরি সংস্পর্শে আসতেন এবং তাদের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করতেন। এ কারণে স্থানীয় জনগণ সহজেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

বাংলাদেশে সুফিবাদের প্রচার কার্যক্রমের মধ্যে কিছু বিশিষ্ট সুফি সাধক রয়েছেন, যারা বাংলায় ইসলামের প্রসারে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে হজরত শাহজালাল (রহ.), শাহ মকদুম (রহ.), খানজাহান আলী (রহ.) এবং শাহ পরান (রহ.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হজরত শাহজালাল (রহ.) বাংলার সিলেট অঞ্চলে ইসলামের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৩০০ শতাব্দীর শেষ দিকে পারস্য থেকে সিলেটে আসেন এবং তার আধ্যাত্মিক শক্তি ও মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেন। ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, তিনি চাচা শাহ কামালের কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং পরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। তার শিষ্যরা সিলেটের গ্রামাঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে দেন এবং মানুষকে ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষা প্রদান করেন।

হজরত খানজাহান আলী (রহ.) বাগেরহাট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে সুফি দর্শন ছড়িয়ে দেন। তিনি তার নিপুণ স্থাপত্যশিল্পের জন্যও পরিচিত, যার মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ উল্লেখযোগ্য। হজরত খানজাহান আলী (রহ.) সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি জলাশয় খনন এবং অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে স্থানীয় জনপদের উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে সুফি মতবাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছিল, যা ইসলামকে সহজেই গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।

ধর্মীয় গণ্ডি সীমানা ছাড়িয়ে সুফিবাদ এবং স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যা ইসলামের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলা অঞ্চলে হিন্দু-বৌদ্ধ প্রভাবিত আধ্যাত্মিকতা এবং লোকসংস্কৃতির সঙ্গে সুফি মতবাদ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থান তৈরি করেছিল। সুফিরা ইসলামের মূল শিক্ষা এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করেছিলেন, যা লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামের এক অনন্য সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিল। বাংলাদেশে বাউল গানের মধ্যেও সুফি আধ্যাত্মিকতার প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাউলরা ধর্ম, জাতি, বর্ণের ঊর্ধ্বে মানবতার গান গেয়েছেন, যা সুফিবাদের সর্বজনীন প্রেম এবং আত্মিক প্রশান্তির খোঁজার সঙ্গে মিলে যায়। বাউলদের মতো সুফিরাও আত্মার পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর সঙ্গে প্রেমময় সংযোগ স্থাপনের জন্য বিশেষ ধ্যানের প্রয়োজনীয়তা বুঝতেন এবং প্রচার করতেন। পাশাপাশি, মুঘল আমলে সুফি সাধকদের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। সুফি সাধকগণ ধর্মীয়ভাবে সমর্থিত সামাজিক স্থিতিশীলতার দিকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিচালিত করতে চেষ্টা করতেন। অনেক শাসক সুফিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাদের সহযোগিতায় শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। উদাহরণস্বরূপ, সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ শাহজালালের (রহ.) প্রতি বিশেষ সম্মান দেখিয়েছিলেন এবং তার সহযোগিতায় ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন।

সুফিদের উদারতা, মানবিকতা এবং সাম্যের দৃষ্টিভঙ্গি স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রভাব ফেলেছিল এবং এই অঞ্চলে ইসলামের মসৃণ প্রচারে সহায়ক ছিল। এছাড়া, সুফিরা জাকাত, দান এবং সামাজিক সেবার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করেন। ফলে, ইসলামের শিক্ষা দ্রুত গ্রহণযোগ্য হয় এবং নতুন মুসলিম সমাজ গঠিত হয়। সুফিদের প্রভাব কেবল তাদের সময়কালেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাদের আধ্যাত্মিকতা এবং মানবিকতাবাদ বাংলার মুসলিম সমাজের ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আজও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সুফি সাধকদের দরবার /দরগা কেন্দ্র করে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তথ্য-উপাত্ত প্রমাণ করে যে বর্তমানেও কতিপয় কামেল আওলিয়াগণের দরবার থেকে হতদরিদ্র মানুষের কল্যাণে নিয়মিত সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সর্বোপরি, হজরত শাহজালাল (রহ.) এবং শাহ মকদুম (রহ.)-এর মাজারগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি প্রমাণ করে যে সুফি সাধকদের আধ্যাত্মিক শক্তি এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও জনমনে গভীরভাবে প্রোথিত।

সুফিবাদের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এর সহনশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে বহুলাংশে টিকে আছে। সুফি সাধকদের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ বাংলায় একটি উদার এবং সমন্বয়মূলক ইসলামের বিকাশ ঘটেছে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে।

বাংলাদেশে সুফিবাদ আজও সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক চর্চা হিসেবে প্রচলিত থাকলেও এর সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশে সুফিবাদের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো বহুমাত্রিক এবং জটিল। একদিকে, বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির প্রসারের ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সুফি আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের ধর্মীয় ক্ষেত্রে কট্টরপন্থার উত্থানও সুফিবাদের জন্য বড় একটি হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী সুফিবাদের উদার, মানবিকতাবাদী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক দর্শনকে সমালোচনা করে থাকে, বিশেষ করে মাজারভিত্তিক পীরভক্তি এবং আধ্যাত্মিক সাধনাকে তারা ‘শিরক’ ও ‘বিদাত’ হিসেবে চিহ্নিত করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুফিবাদের ভিত্তি নিয়েও ইদানীং প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। তবে প্রথিতযশা ইসলামি চিন্তাবিদগণের মতে, তাসাউফ সুফিবাদের মূল উৎস এবং এই তাসাউফের শিক্ষা রাসুল (সা.)-এর সময় থেকেই চালু আছে। তাদের মতে, মসজিদে নববীর বারান্দায় একশ্রেণির সাহাবি সবসময় অবস্থান করতেন এবং আল্লাহর ইবাদতে সর্বদা মসগুল থাকতেন, যাদের “আসহাবে সুফফা” বলা হয়। মূলত তাদের মাধ্যমেই সুফিবাদের গোড়াপত্তন হয়, যা পরে বিবর্তিত হয়েছে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, কতিপয় সুফি প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সমালোচকগণের মতে, কিছু দরবার/দরগা  আধ্যাত্মিকতার চেয়ে আর্থিক প্রাপ্তি এবং সামাজিক প্রভাব বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করায় সুফিবাদকে  আরও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে।

অধিকন্তু, কতিপয় পথভ্রষ্ট প্রতিষ্ঠানের আধ্যাত্মিকতার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতির ফলে অনেক সাধারণ মানুষ সুফি দর্শনের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ইসলামি আলেম এবং চিন্তাবিদদের একটি বড় অংশের মতে, যারা অনৈতিক এবং বেশরিয়াতি কাজে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ এবং অহিংস ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে ইসলামের লেবাসধারী গুটিকয় অনৈতিক মানুষের দায় গোটা সুফি সম্প্রদায়ের ওপর চাপানো অন্যায় এবং ইসলামবহির্ভূত কাজ হবে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুফিবাদের অন্তর্নিহিত উদারতা এবং মানবিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি, যাতে এটি আধুনিক সমাজে তার ভূমিকা বজায় রাখতে পারে। বাংলাদেশে ইসলামের প্রচারে সুফিবাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং সুদূরপ্রসারী। সুফি সাধকরা তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাবের মাধ্যমে ইসলামকে এই অঞ্চলে গভীরভাবে প্রোথিত করেছিলেন। তারা কেবল ধর্মীয় প্রচারক হিসেবেই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পথিকৃৎ হিসেবেও কাজ করেছেন। তাদের প্রচেষ্টার ফলে বাংলায় ইসলামের এক উদার, সহনশীল এবং মানবিক রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা আজও বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ।

লেখক:ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান, লোক-প্রশাসন গবেষক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ