Search
Close this search box.

জনসেবায় পেশাদারিত্ব: জনবান্ধব প্রশাসনের পূর্বশর্ত

জনসেবায় পেশাদারিত্ব: জনবান্ধব প্রশাসনের পূর্বশর্ত

ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান

একটি কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো জনসেবা খাত (Public Service Sector), যার মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে থাকে। জনসেবা খাতের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সুশাসনের পূর্বশর্ত। জনসেবা কার্যক্রমের দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তবে বাংলাদেশে, জনসেবা খাত বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, যার মূলে রয়েছে পেশাদারিত্বের অভাব। তবে, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে জনসেবা খাতে পেশাদারিত্ব নিশ্চিতকরণের সফল উদাহরণ রয়েছে, যা বাংলাদেশে প্রয়োগ করা সম্ভব।

পেশাদারিত্ব বলতে বোঝানো হয় একটি নির্দিষ্ট কাজ বা দায়িত্ব পালনে সুশৃঙ্খল ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা, যেখানে নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা বজায় থাকে। পেশাদারিত্ব জনসেবা খাতে তখনই গুরুত্ব পায়, যখন সেবা প্রদানকারীদের থেকে জনগণ নির্ভরযোগ্য, সময়মতো এবং মানসম্পন্ন সেবা প্রত্যাশা করে। পেশাদারিত্বের অভাব জনসেবা খাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল করে তোলে, যা জনগণের আস্থা ও রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে জনসেবা খাতে পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অত্যধিক। কারণ, এখানে সরকারি সেবাগ্রহণ সাধারণ জনগণের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই একমাত্র বিকল্প এবং এই সেবাগুলোর গুণগত মান প্রত্যক্ষভাবে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের ওপর প্রভাব ফেলে। একটি সুশাসিত ও পেশাদার জনসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে রাষ্ট্র তার উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার জনসেবার মান উন্নয়নে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জনসেবাকে ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। জনসেবায় সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য ‘সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি’  (Citizen’s Charter), সেবা প্রাপ্তিতে অসন্তুষ্টি প্রতিকার ব্যবস্থা (Grievances Redress System) প্রবর্তন  করা হয়েছে। সমালোচকগণ মনে করেন, বিভিন্ন ব্যবস্থা চালু করা হলেও তা সত্যিকার অর্থে কার্যকর করা এখন সম্ভব হয়নি। এই অকার্যকারিতার পিছনেও পেশাদারিত্বের অভাব অনেকাংশে দায়ী বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।

বাংলাদেশে জনসেবা প্রদানে পেশাদারিত্বের অভাব একটি গভীর ও বহুমাত্রিক সমস্যা, যা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব প্রধানত জনসেবা ব্যবস্থার কার্যকারিতা হ্রাস করে। অনেক ক্ষেত্রে, কর্মকর্তারা সেবাগ্রহীতাদের মৌলিক চাহিদা এবং প্রত্যাশা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখেন না, যা সেবার মানকে নিম্নমানের করে তোলে। জনসেবা খাতে নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং পরবর্তী প্রশিক্ষণ কাঠামোতে ঘাটতির ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা চালু করা হলেও অনেক কর্মচারী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অদক্ষ, যা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হ্রাস করে। অন্যদিকে, দুর্নীতি একটি প্রধান বাধা, যা পেশাদারিত্বের ঘাটতি ঘটায়। সরকারি দফতরগুলোতে ঘুষ ও অবৈধ অর্থের লেনদেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলে সেবাগ্রহীতারা তাদের প্রাপ্য সেবা পেতে অসহায় হয়ে পড়েন। এই দুর্নীতি শুধু সেবার মানকে নষ্ট করে না, বরং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়, যা সুশাসনের প্রতিষ্ঠাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

জবাবদিহির অভাবও অপেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কর্মকর্তাদের কাজের মান পর্যবেক্ষণের জন্য কার্যকর কোনও ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেকেই নিজেদের দায়িত্ব পালনে উদাসীন থাকেন। বর্তমানে ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি’ (এপিএ) ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও এটি সেবা প্রদানের সত্যিকারের চিত্র কার্যকরভাবে প্রতিফলন করতে এখন সমর্থ হয়নি বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ই-সেবার মান নিচে নামলেও কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনার সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত অপ্রতুল। যার ফলে সেবার  গুণগত মান নষ্ট হয় এবং জনগণের আস্থা কমে যায়। এছাড়া, সেবার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অভাবের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি  হয়। যখন নাগরিকরা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অসংখ্য বাধা এবং সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন, তখন তাদের মধ্যে সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে।  অধিকন্তু, জনসেবা প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এর ফলে সাধারণ জনগণকে বিভিন্ন ধাপে যেতে হয় এবং এই ধীর প্রক্রিয়ার কারণে তাদের সেবাগ্রহণের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ফলে দুর্ভোগ বাড়ে এবং কখনও কখনও তারা সেবা পাওয়ার আশাই ছেড়ে দেন। সেবার এই ধীরগতি ও জটিলতা পেশাদারিত্বের অভাবের একটি চিহ্ন।

অতএব, বাংলাদেশের জনসেবা খাতে পেশাদারিত্বের অভাব একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ, যা সমাধানের জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশ জনসেবা খাতে পেশাদারিত্বের সফল উদাহরণ স্থাপন করেছে। এসব উদাহরণ বাংলাদেশে পেশাদারিত্ব উন্নয়নের জন্য একটি দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করতে পারে। যেমন, সিঙ্গাপুরের জনসেবা খাত পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার জন্য বিখ্যাত। সিঙ্গাপুরের Public Service Division (PSD) নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মীদের সক্ষমতা বাড়ায়। সিঙ্গাপুরের জনসেবা কর্মকর্তারা জনগণকে স্বচ্ছ, দ্রুত এবং নির্ভুল সেবা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সিঙ্গাপুরের এই মডেল থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে, যেখানে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মীদের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব। পাশাপাশি, কানাডার জনসেবা খাত Performance Management System ব্যবহার করে, যা কর্মকর্তাদের কাজের মান পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের কাজের মূল্যায়ন করে। ভালো কাজের জন্য প্রণোদনা প্রদান এবং খারাপ কাজের জন্য সংশোধনী ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের মধ্যে জবাবদিহি ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা হয়। এছাড়াও, ফিনল্যান্ডে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার জনসেবা খাতকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছে। তাদের e-governance ব্যবস্থা জনগণকে সহজে ও দ্রুত সেবা প্রদান করছে।

বিদ্যমান বাস্তবতা এবং বৈশ্বিক শিক্ষার আলোকে বাংলাদেশের জনসেবা খাতে পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পেশাদারিত্ব নিশ্চিতকরণে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন এর কোনও বিকল্প নাই। সেবার মান উন্নত করার জন্য সরকারকে নিয়মিত কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

আধুনিক প্রযুক্তি, ই-গভর্ন্যান্স, এবং অন্যান্য সেবাসমূহের জন্য কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা গেলে দক্ষতার অভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। পাশাপাশি নীতি নৈতিকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করাও জরুরি।

কর্মকর্তাদের কাজের মান নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সময়মতো সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। পারফরম্যান্স মূল্যায়নের মাধ্যমে যারা ভালো কাজ করছেন তাদের পুরস্কৃত করা এবং যারা কাজের মান বজায় রাখতে পারছেন না তাদের সংশোধন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিদ্যমান ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি’ (এপিএ) ব্যবস্থাকে আরও নৈর্ব্যক্তিক করে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করা দরকার। বিদ্যমান সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি কী পরিমাণে অনুসরণ করা হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিয়মিত নিরপেক্ষ গবেষণা পরিচালনা করা কার্যকর হতে পারে। ভারতের মতো সেবা প্রদান নিশ্চিতকরণ আইন ( Service Guarantee Act)  প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে কর্মচারীদের কাজে অবহেলার জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করে শাস্তি প্রদান করা যাবে। পাশাপাশি, জনগণের মতামত গ্রহণ করার জন্য কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

এছাড়া, দুর্নীতি কমানোর জন্য সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি সেবা প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত রাখতে একটি নিরীক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যাতে সেবাগ্রহীতারা সঠিক সময়ে ও সঠিক মানের সেবা পান। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।  অধিকন্তু, কর্মস্থলে নৈতিকতার চর্চা ও পেশাদার সংস্কৃতি গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। কর্মস্থলে নৈতিকতা এবং পেশাদার আচরণ চর্চার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব বাড়ানো যেতে পারে। নৈতিক মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়ে কর্মক্ষেত্রে পেশাদার সংস্কৃতি গড়ে তোলা হলে কর্মচারীরা আরও দায়িত্বশীল ও সচেতন হবেন। জাপানে সরকারি কর্মকর্তাদের নৈতিক আচরণ এবং দায়িত্ব পালনে পেশাদারিত্ব বজায় রাখার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং নীতিমালা রয়েছে।

বাংলাদেশেও সরকারি খাতে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে এই ধরনের মূল্যবোধ উন্নয়ন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থার প্রসার ঘটিয়ে সেবা প্রদান প্রক্রিয়াকে সহজ ও দ্রুত করা যেতে পারে। ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতারা সরাসরি অনলাইনে সেবা প্রদানের কার্যক্রম বিচক্ষণতার সঙ্গে আরও জোরদার করতে হবে।

বাংলাদেশের জনসেবা খাতে পেশাদারিত্ব উন্নয়ন একটি জরুরি প্রয়োজন। দক্ষতা উন্নয়ন, স্বচ্ছতা, দুর্নীতি দমন এবং সেবার প্রক্রিয়া সহজীকরণের মাধ্যমে এই খাতকে আরও পেশাদার করা সম্ভব। বৈশ্বিক উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশের জনসেবা খাতে পেশাদারিত্ব বাড়ানো গেলে সেবার মান বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জনসেবা খাতে পেশাদারিত্বের উন্নতি কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়াবে না, বরং নাগরিকদের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা বাড়াবে এবং রাষ্ট্রের সুশাসনের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করবে।

লেখক: লোক-প্রশাসন গবেষক এবং জননীতি বিশ্লেষক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ