‘পোষা মানুষ’ কেমন মানুষ?
রেজানুর রহমান
রাজার বাড়ির কুকুর বিড়ালেরও অনেক মান-মর্যাদা। আমাদের এই দেশে পোষা কুকুর-বিড়ালের জন্য যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয় তা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। অনেকে হয়তো ভাবছেন আমি কি তাহলে পশু-পাখিদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য লেখাটি শুরু করেছি? জি না। পশু-পাখিদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আমার এই লেখা নয়। বরং তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। একবার ভাবুন তো আমাদের চারপাশে কুকুর বিড়াল নেই। আকাশে পাখি উড়ছে না। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ নেই। বিড়ালের মিউ মিউ শব্দও নেই। গাছের ডালে পাখিদের কিচির-মিচির শব্দও নেই। তখন কেমন হবে পরিবেশ? মানুষ ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই। একটা হাহাকার শুরু হয়ে যাবে। কুকুর, বিড়ালসহ অন্যান্য পশুপাখি মানুষের বন্ধু বটে। কাজেই তাদের প্রতি মানুষের আলাদা টান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের টানটা কেমন? সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন তার পিয়নের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নাকি ৪০০ কোটি টাকা? তাও আবার দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সে কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। এই তো কয়েক দিন আগে পত্রিকায় খবর হলো দেশের একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ীর গৃহকর্মীর ব্যাংক হিসাবে নাকি কোটি টাকার স্থায়ী আমানত আছে। এই খবরটাও ব্যাপক হইচই ফেলে দিয়েছে। ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। যারা হইচই করছেন, সমালোচনার পারদ ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, তাদের উদ্দেশে আমার আজকের এই লেখার শুরুর অংশটা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই।
রাজার বাড়ির কুকুর বিড়ালেরও অনেক মান-মর্যাদা। সেখানে মানুষের মর্যাদা কতখানি, মালিক শত শত কোটি টাকার মালিক। সেখানে তার গৃহকর্মীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানত থাকাটাই স্বাভাবিক। পোষা কুকুর বিড়ালের জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করা হলে পোষা মানুষের জন্য কোটি টাকা খরচ করা কোনও ব্যাপারই না। কিন্তু একজন পোষা মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যখন ৪০০ কোটি টাকা থাকে তখনই সন্দেহ, অবিশ্বাসের ডালপালা বেড়ে যায়। পোষা মানুষের সঙ্গে সাধারণ মানুষের আকাশ-পাতাল ব্যবধান প্রকট হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ তখন পোষা মানুষ হবার প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে ওঠে। তোরা যে যা বলিস ভাই আমি একজন পোষা মানুষ হতে চাই! পোষা মানুষের অনেক সুবিধা। শুধু জি হুজুর, জি হুজুর করলেই চলে। কে কোথায় কতটা অন্যায় করলো, দুর্নীতির পাহাড় গড়লো, দেশ বিক্রির ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো, বিরোধী পক্ষকে হাজতে পাঠালো, পোষা মানুষেরা এসব বিষয়ে দেখেও না দেখার ভান করে। পোষা মানুষদের এটাই ধর্ম। চুপ থাকলেই লাভ। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাবে কোটি কোটি টাকা। একটু চাটুকারিতা, ন্যায় অন্যায় না ভেবে সব কিছুতেই ‘হ্যাঁ’ বলা। স্বৈরাচারকে অন্যায়, অবৈধ কর্মকাণ্ডে সমর্থন করা পোষা মানুষদের মূল কাজ। সেজন্য পোষা কুকুর বিড়ালের মতো পোষা মানুষেরাও মালিকের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে পোষা মানুষ আর পোষা পশু-পাখিদের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। পোষা কুকুর রাতে বাড়ি পাহারা দেয়। শত্রুর গতিবিধি টের পেলে ঘেউ ঘেউ করে উচ্চস্বরে ডাক দেয়। মালিককে সতর্ক করে। পোষা মানুষদেরও একই দায়িত্ব। মালিক বিপদে পড়লে বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে মালিককে বিপদ থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু শেষ রক্ষায় অর্থাৎ সমূহ বিপদের দিনে পোষা কুকুরটি মালিকের পাশে থাকলেও পোষা মানুষদের অনেকেই থাকে না। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’- পোষা মানুষদের অনেকেই তখন এই থিউরির পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়।
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পোষা মানুষদের অবস্থা বেশ কাহিল। কেউ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। আবার পালাতে গিয়ে অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের জেরার মুখে অনেকেই ঊর্ধ্বতনদের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। পোষা মানুষদের এমনই কাহিল অবস্থা। তাই বলে কি অদূর ভবিষ্যতে পোষা মানুষদের সংখ্যা কমে যাবে? ‘জি হুজুর, জি হুজুর মার্কা’ মানুষদের আর দেখা যাবে না? তাহলে তো রাষ্ট্রের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আশা করাই যায়। কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত পোষা মানুষদের সংখ্যা আদৌ কমে গেছে? বোধ করি না। বরং পোষা মানুষদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তেলবাজ, দলবাজ, দলদাস মানুষদের সংখ্যা একটুও কমেনি। ভিন্ন নামে, ভিন্ন পরিচয়ে তারা আবার নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চাঁদাবাজি, জবরদখলসহ নানা প্রক্রিয়ায় আবার সরব হচ্ছে পোষা মানুষেরা। আবার কেউ পোষা মানুষদের পরামর্শে আধিপত্য বিস্তারের ঘৃণ্য লড়াইয়ে লিপ্ত।
রাজধানীর সাতরাস্তা এলাকায় অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড হতে পারে এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ঢাকার সাবেক মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে সাতরাস্তার এই রাস্তাটিকে জনসাধারণের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করা হয়েছিল। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর একটি মহল রাস্তাটিকে আবার ট্রাকস্ট্যান্ডে পরিণত করে। এই ক্ষেত্রে দলদাস পোষা মানুষদের ভূমিকাই বেশি। যারা সুযোগসন্ধানী, সুসময়ের বন্ধু, অসময়ে তাদের ধারে-কাছেও পাওয়া যায় না।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে যত অন্যায়, অবিচার, অনিয়ম হয়েছে তার পেছনে স্বৈরাচারের ভূমিকা ছিল প্রকট। সবসময় স্বৈরাচারকে কুমন্ত্রণা, কূটবুদ্ধি দিয়েছে পোষা মানুষরাই। এদের কাজই হলো সুদিনে আপনার জন্য জীবন দিতে পারি এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। দুর্দিনের আভাস পেলেই এরা সচতুর কায়দায় সটকে পড়ে। ভাবটা এমন-আমার কী দোষ? আমি তো কিছু করি নাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ধন্যবাদ জানাই। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে দেশ একটি নতুন পরিবেশ পেয়েছে। দেশের মানুষের মনে নতুন স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে। বৈষম্যহীন একটি দেশের স্বপ্ন। এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে হলে পোষা মানুষদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে। সুযোগসন্ধানীরাও এক ধরনের পোষা মানুষ। ‘কাজের বেলায় কাজী কাজ ফুরালেই পাজি’- সুযোগসন্ধানীদের বেলায় এই কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছেন আশা করি তারা পোষা মানুষদের গুরুত্ব দেবেন না। পোষা মানুষ ভুল মানুষ। আসুন ভুল মানুষকে এড়িয়ে চলি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো