Search
Close this search box.

চট্টগ্রাম ‘কেলেঙ্কারি’র মাস্টারমাইন্ড জসিম এখন এনআরবি লাইফে!

স্টাফ রিপোর্টার: যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির গ্রাহকদের স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিয়ে তা জীবন বিমায় রূপান্তর করে জালিয়াতি ও প্রতারণায় জড়িত কর্মকর্তাকে চাকরি দিয়েছে নতুন প্রজন্মের জীবন বিমা কোম্পানি এনআরবি ইসলামিক লাইফ। প্রতারণায় জড়িত ওই কর্মকর্তার নাম মো. জসিম উদ্দিন। তিনি যমুনা লাইফের সাবেক অ্যাডিশনাল এমডি। বর্তমানে তিনি এনআরবি ইসলামিক লাইফে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।

যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রায় ৯৩ জন গ্রাহককে স্থায়ী আমানত বা এফডিআরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুই কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জীবন বিমায় রূপান্তরের নেপথ্যের নায়ক জসিম উদ্দিন। এফডিআরে পাঁচ শতাংশ কমিশন হলেও সেখানে তারা এফডিআরের নামে টাকা নিয়ে জালিয়াতি করে তা সিঙ্গেল বিমায় রূপান্তর করে ৯৫ শতাংশ কমিশন বাগিয়ে নিয়েছেন। এই জসিম উদ্দিন তখন অ্যাডিশনাল এমডির পাশাপাশি যমুনা লাইফের মার্কেটিং বিভাগেরও প্রধান ছিলেন।

যমুনা লাইফের গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সম্প্রতি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) একটি তদন্ত করে। তদন্তে জালিয়াতি ও প্রতারণার সঙ্গে জসিম উদ্দিনের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি ছাড়াও যমুনা লাইফের সদ্য সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল হাসান খন্দকারের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে। আরও জড়িত ছিলেন এসএএমডি মো. রবিউল ইসলাম।

বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্র জানায়, এ ঘটনায় চাকরি হারিয়ে পলাতক রয়েছেন কোম্পানির কর্মকর্তা এসএমডি মো. রবিউল ইসলাম। অপরদিকে সদ্যবিদায়ী সিইও কামরুল হাসানের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদনও না মঞ্জুর করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। তবে ওই দুই কোটি ৩৪ লাখ টাকা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও বিমা খাতে বহালতবিয়তে আছেন জসিম উদ্দিন।

জসিম উদ্দিনের পূর্ববর্তী কর্মস্থলগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি ব্যবসায় সফল হলেও নানা কর্মকাণ্ডের কারণে বিতর্কিত ছিলেন। তার পূর্ববর্তী কর্মস্থল রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে তদন্ত করা হলে ‘ভয়ংকর স্পর্শকাতর’ তথ্য উঠে আসবে বলে নিশ্চিত করেছেন রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।

এদিকে যমুনা লাইফের প্রতারণায় জড়িতকে এনআরবি ইসলামিক লাইফে চাকরি দেয়ায় নতুন করে প্রতারণা ও কেলেঙ্কারি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। বিমা বিশেষজ্ঞ অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিমা অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি খাত। সাধারণ মানুষ এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাদের অর্থের নিরাপত্তাসহ জীবনের নানা বিষয়ে ঝুঁকি বহন করাই বিমা কোম্পানির কাজ। তবে প্রমাণিত জালিয়াত বা প্রতারকরা যদি নতুন করে কাজের সুযোগ পায়, তাহলে ফের প্রতারণা হবে না— তা জোর দিয়ে বলা মুশকিল। গ্রাহকের স্বার্থেই স্বচ্ছ ও সৎ মানুষদের এ খাতে আনা উচিত।

জসিম উদ্দিনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। তার সাবেক কর্মস্থল সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে দেয়া জীবনবৃত্তান্ত এসেছে আমার সংবাদের কাছে। সেটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। যদিও এই সনদের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের বিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা।

তদন্তে প্রতারণা প্রমাণিত জসিম উদ্দিনকে চাকরি দিয়ে তাকে নতুন করে প্রতারণার সুযোগ দেয়া হচ্ছে কি না— সে বিষয়ে জানতে চেয়ে এনআরবি ইসলামিক লাইফের (ভারপ্রাপ্ত) মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরবর্তীতে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে জানতে চাওয়া হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। ফলে এ বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

যমুনা লাইফ নিয়ে আইডিআরএর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে দুই দফায় কোম্পানির চট্টগ্রাম মডেল সার্ভিস সেন্টারের ৯৩ গ্রাহকের কাছ থেকে এক বছর মেয়াদি এফডিআরের কথা বলে দুই কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা নিয়ে ১২, ১৫ ও ২১ বছর মেয়াদি পলিসি করা হয়েছে, যা বিমা আইনের পরিপন্থি। এই প্রতারণার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা মোটা অঙ্কের কমিশন বাগিয়ে নিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, জড়িতরা প্রতি লাখে মাসিক ১০০০ টাকা ও বছর শেষে ৯ শতাংশ ইনসেনটিভ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই প্রতারণা করেছে। এর সঙ্গে মো. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী, মো. মিসির রায়হান ও মো. আতিকুর রহমান নামের তিনজনের যোগসাজশ ছিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যমুনা লাইফের তৎকালীন সিইও কামরুল হাসান খন্দকার ২০২০ সালে ৪৫/২০২০ নং প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোম্পানির এফডিআর-সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে, যা বিমা আইন ২০১০-এর বিধি, প্রবিধান ও আইডিআরের নির্দেশনার পরিপন্থি। এছাড়াও তিনি ও কোম্পানির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) চট্টগ্রাম সার্ভিস সেন্টার পরিদর্শনের সময় এফডিআর করার জন্য মাঠকর্মীদের নির্দেশ দেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তৎকালীন সিইওর মৌখিক নির্দেশনা ও ৪৫/২০২০ নং সার্কুলারের প্রেক্ষিতে ওই সময় এএমডি পদে কর্মরত থাকা মো. জসিম উদ্দিন এবং এসএএমডি মো. রবিউল ইসলামের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোম্পানির চট্টগ্রামস্থ সার্ভিস সেন্টারের মো. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী, মো. মিসির রায়হান ও মো. আতিকুর রহমান চট্টগ্রাম মডেল সার্ভিস সেন্টারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের লাখে মাসিক ১০০০ টাকা ও বছরান্তে অতিরিক্ত ৯ শতাংশ ইনসেনটিভ প্রদানের শর্তে এক বছর মেয়াদি এফডিআরের লোভ দেখান।

কৌশলে ওই প্রতারকচক্রটি দুই কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকার পুরো তহবিলটি যমুনা লাইফের হিসাবে ট্রান্সফার করে। তারা প্রতিষ্ঠানের ৯৩ সদস্যের নামে ১২, ১৫ ও ২১ বছর মেয়াদি তিন কিস্তি বিমার প্রস্তাবপত্র পূরণ করে জাল মেডিকেল সনদপত্র যুক্ত করে অবলিখন বিভাগে দাখিল করে এবং এক কোটি আট লাখ ৩২ হাজার ১৭৫ টাকা কমিশন হাতিয়ে নেয়।

এই কমিশনের মধ্যে ৩০ শতাংশ এফএ কমিশন বাবদ ৬৯ লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা, ইউনিট ম্যানেজারের কমিশন বাবদ ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৫০ টাকা এবং ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের কমিশন বাবদ ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ১২৫ টাকা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এক গ্রাহক এ ঘটনায় বাদী হয়ে চট্টগ্রাম আদালতে অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন। সে মামলায় এএমডি জসিম উদ্দিনকে দ্বিতীয় আসামি করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জসিম উদ্দিন বলেন, আমি এমন কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত নই; আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। এই অভিযোগের বিপরীতে তার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে বলেও দাবি করেন তিনি এবং তার কাছে থাকা যাবতীয় প্রমাণাদি দিয়ে তিনি আইডিআরএর তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান সাংবাদিকদের। তার কাছে থাকা তথ্য-প্রমাণ এই সংবাদের প্রতিবেদককে দেখাতে পারবেন বলে সময়ও নেন তিনি। এরপর দীর্ঘ কালক্ষেপণ করেও তিনি তার দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণাদি দেখাতে পারেননি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ