সাত কলেজের সমস্যা কি সমাধান হলো

ফিরোজ মান্না : 
রাজধানীর সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি কি মেনে নেয়া হয়েছে। না কি বিষয়টি আরো জটিল হলো। এখন সাত কলেজের কর্তৃপক্ষ হবে কে? ছাত্ররা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি করে আসছেন। তবে তাঁরা স্পষ্ট করে বলছেন, কোনোভাবেই আগের মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তাঁরা যাবেন না। এতে তো আরও জটিলতা বাড়লো। এই কলেজ গুলোর দেখভাল করবে কারা। সনদই বা দেবে কে। এমন প্রশ্নই এখন উঠে এসেছে। সরকার এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই ভেবে চিন্তেই সিন্ধান্ত নিয়েছে। তবে সমস্যা কি একেবারেই চলে যাবে। এটি এখন দেখার বিষয়।

রবিবার থেকে ঢাকার একাধিক সড়ক অবরোধ করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে যায়। সেই আন্দোলন চলে সোমবার বিকাল পর্যন্ত । আন্দোলনকারীরা সরকারকে কয়েক ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্ত সাত কলেজ আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সাত কলেজ হলো- ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।

জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা বলছেন এসব কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি ছাড়াও বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে এসে হেনস্থার শিকার হতে হয়। ছাত্রদের বার বার রাস্তায় নামার কারণ আরো রয়েছে-সেগুলো হলো রুটিন ও পরীক্ষা নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থাসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না করা। ছাত্ররা অন্তত ৩৫টি দাবি করেছি বিভিন্ন সময়। কিন্তু কোনটিরই সমাধান হয়নি। কেউ দায়িত্ব নেয় না। ক্লাস রুটিন পর্যন্ত ঠিক মতো হয় না। এভাবে তো চলতে পারে না। এগুলো ঠিক হয় না বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি উঠেছে। আজকে অচলাবস্থার সূচনা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদের দুর্ব্যবহারকেই দায়ী করছেন ছাত্ররা। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি নিয়ে অধ্যাপক মামুন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি অসদাচরণ করেন। পরে অবশ্য অধ্যাপন মামুন আহমেদ তার ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, সাত কলেজ পরিচালনায় যথাযথ মনোযোগ না দেয়ার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতার ঘাটতির কারণেই বারবার সংকট তৈরি হচ্ছে। এই সংকটের জের ধরেই নিয়মিত বিরতিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামছে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাতটি কলেজকে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিলো এমন প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য জবাব নেই কারও কাছেই। বরং অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ডঃ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত নভেম্বরে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় বলেছিলেন যে,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্তটি ছিলো অপরিণামদর্শী। অপরিকল্পিতভাবে অধিভুক্ত করার ফলে শুরু থেকে কলেজ গুলোতে নানা সমস্যা ও সংকট লেগে রয়েছে।
সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ. আ. ম. স আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের মধ্যকার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরেই তখন ওই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া হয়।

জানা গেছে, বিগত আট বছরেও সাতটি কলেজের পরিচালনায়, বিশেষ করে ভর্তি, পরীক্ষা, কলেজ পরিদর্শন, মূল্যায়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি এই আট বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে অধিভুক্ত কলেজগুলোর জন্য আলাদা কোন সেল বা ডেস্ক খুলতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনিক ভবনে আলাদা কোন শাখাও নেই যেখানে এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা গিয়ে দ্রুত সেবা পাবেন। লোকবলের ঘাটতি তো আছেই, তবে এর চেয়ে বড় সংকট হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্ব নিয়েও কলেজগুলোর দিকে যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয়নি।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যায়। এরপর প্রায় দুই দশক ঢাবি কলেজ পরিচালনা কার্যক্রমের বাইরে থাকায় এ ধরনের কাজের সক্ষমতাও হারিয়ে যায়। ফলে হুট করে সাত কলেজকে নিয়ে আসার পর দেখা গেলো ঢাবির লোকবল ও সক্ষমতা নেই। যে কারণে শিক্ষার্থীরা দেখছে তাদের সাত কলেজ অন্য কলেজগুলোর চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অক্টোবরে ছাত্ররা আবার রাস্তায় নেমে আসে। তখন স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের দাবিকে কেন্দ্র করে কয়েক সপ্তাহ ধরে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে জড়ো হয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে।
পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ একটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, সাত সরকারি কলেজ দেখভালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই পুরোপুরি আলাদা একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে আলাদা রেজিস্ট্রারসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবে। কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তই থাকবে। গত ৩১শে অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানালেও শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।

অন্যদিকে, ছাত্রদের দাবি তুলেছিলো তিতুমীর কলেজসহ বেশ কয়েকটি কলেজকে বিশ্ব বিদ্যালয় করতে হবে। কিন্তু সাত কলেজের শিক্ষকরা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার থেকে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় হলে তাদের কী হবে সেই প্রশ্নও আছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত হলেও এসব কলেজ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে তা পরিষ্কার না।

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ