স্টাফ রিপোর্টার- সিরাজগঞ্জে তিন শতাধিক চরমপন্থি স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন। র্যাব সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, মেহেরপুর কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও টাঙ্গাইল জেলার এসব চরমপন্থি আত্মসমর্পণ করবে রবিবার (২০ মে) সকালে।
একসময় চরমপন্থিদের অভয়ারণ্য ছিল এ ৭ জেলা। এসব এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক একটি জনপদ ছিল আতঙ্কের নাম। প্রতিদিনই চাঁদাবাজি, গুম, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটত। মার্কস-লেলিন ও মাওবাদী আদর্শের নামে ১৪টি চরমপন্থি সংগঠন সক্রিয় ছিল এই জনপদে। এর মধ্যে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এম এল (লাল পতাকা), পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (এমবিআরএম) ও পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (জনযুদ্ধ) অন্যতম। ১৯৬৮ সাল থেকে এসব সংগঠন বিস্তৃত হতে থাকে। তরুণসমাজকে ভুল বুঝিয়ে দলে টানতে থাকে চরমপন্থিদের শীর্ষনেতারা। আশি-নব্বইয়ের দশকে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে চরমপন্থি সংগঠনগুলো।
সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দিয়ে আলাদা রাজত্ব কায়েম করতে থাকে তারা। হত্যা করা হয় কয়েক হাজার মানুষকে। পরে আধিপত্য বিস্তার ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হতে থাকে তারা। একে অপরকে হত্যা করতে থাকে। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়।
এ অবস্থায় ১৯৯৮ সালে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে চরমপন্থি দলের শীর্ষ নেতাসহ শতাধিক সদস্য। এরপর ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল পাবনায় পুলিশের কাছে ৫৯৬ জন চরমপন্থি সদস্য আত্মসমর্পণ করে।
র্যাব জানায়, প্রায় দুই দশক ধরে চরমপন্থিদের দমনে কাজ করছে র্যাব। বন্দুকযুদ্ধে শীর্ষ কয়েক নেতা নিহত হলেও থেমে থাকেনি তাদের কর্মকাণ্ড। ২০২০ সালে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদকে চরমপন্থিদের আগ্রাসন থেকে রক্ষায় তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। র্যাবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা বেশ কয়েকটি সক্রিয় দলের নেতা তিন শতাধিক সদস্য ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের সম্মতি জানায়।
এরই ধারাবাহিকতায় দুই শতাধিক অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করবে ৩২৩ জন চরমপন্থি। এর মধ্যে পাবনা ১৮০, সিরাজগঞ্জে ১১, টাঙ্গাইল ৭৪, রাজবাড়ী ৫৪, মেহেরপুর ২, কুষ্টিয়া ও বগুড়ায় ১ জন করে চরমপন্থি রয়েছে।
সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় র্যাব-১২ সদর দপ্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন তারা। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমেদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান, পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
র্যাব আরো জানায়, উদয়ের পথ নামে একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে চরমপন্থি পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চরমপন্থি পরিবারের ৩০ জন নারী সদস্যকে স্বাবলম্বী করতে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাছ চাষ, গরু বা মুরগির খামার, রিকশা, সেলাই মেশিন প্রদানের মাধ্যমে চরমপন্থি নেতা ও সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হবে।
আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি দলের নেতা মোহাম্মদ সাধু ও রাজু আহমেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আদর্শের নামে এত দিন তারা ভুল পথে ছিল। এখন তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। তাই অন্ধকারের পথ থেকে আলোর পথে ফিরতে চায়।
মোহাম্মদ সাধু বলেন, র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমাদানের উদ্যোগে আমরা রাজি হয়েছি। পথভ্রষ্ট হয়ে এত দিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেছি। এখন আমরা সামাজিক স্বীকৃতি চাই।
র্যাব-১২ অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মারুফ হোসেন বলেন, পূর্ব বাংলা সর্বহারা এবং পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এমএল (লাল পতাকা) তারা বিভিন্ন সোর্সে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা যে ভুল পথে ছিল, সেখান থেকে মূলধারায় ফিরে আসতে চায়। দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে চায়। রবিবার (২১ মে) তিন শতাধিক চরমপন্থি সদস্য আত্মসমর্পণ করবে এবং ২ শতাধিক অস্ত্র জমা দেবে। এর ফলে ওই অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুবিধা হবে।