রাকিব হাসান – তুরস্কের মধ্যাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় সোমবার ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ৪৫০০ ছাড়িয়েছে বলে সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এদিকে রয়টার্স বলছে, সোমবার ভোরে আঘাত হানা ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল চলতি শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। সাইপ্রাস ও লেবাননেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। এর পরেই বিকেলে ৭.৭ মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। দ্বিতীয় ভূমিকম্পে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ধ্বংসস্তূপ থেকে হতাহতদের বের করতে উদ্ধারকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্কে ৯১২ জন নিহত, ৫ হাজার ৩৮৩ জন আহত এবং ২ হাজার ৮১৮টি ভবন ধসে পড়েছে। অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ অব্যাহত থাকায় নিহতের সংখ্যা কত বাড়বে তা অনুমান করতে পারছি না।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম টিআরটির লাইভ ফুটেজে দেখা গেছে, দ্বিতীয় ভূমিকম্পের পর দক্ষিণাঞ্চলীয় আদানা প্রদেশে একটি ভবন ধসে পড়েছে। ভবনটি খালি করা হয়েছে কিনা তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ায় ৩২৬ জনের বেশি মানুষ নিহত ও এক হাজার ৪২ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে উদ্ধারকারীরা। উদ্ধারকাজে নামানো হয়েছে এয়ারক্রাফট। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বানও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
অন্যদিকে, সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে, ভূমিকম্পের আঘাতে ৩২০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ার মানবাধিকারবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা নতুন এ তথ্য জানায়। অন্যদিকে, সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সিরিয়ার এখন পর্যন্ত আহতের সংখ্যা ৬০০। এখনও ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছেন বহু মানুষ।
জানা যায়, এরই মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। ভোরের দিকে আঘাত হানা ভূমিকম্পে বিভিন্ন স্থাপনা কেঁপে ওঠে লেবানন ও সাইপ্রাসেও।
সোমবার মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) ভূমিকম্পের আঘাত হানার বিষয়টি নিশ্চিত করে। ভোরের দিকে আঘাত হানা এই ভূমিকম্পে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তুরস্কের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলেও শক্তিশালী আফটারশক অনুভূত হয়েছে। মূল ভূ-কম্পনটি আঘাত হানার প্রায় ১১ মিনিট পর আরেক দফায় আঘাত হানে ভূমিকম্প। ৬ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী আফটারশক মূল ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের প্রায় ৩২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আঘাত হানে। ১৯ মিনিট পরে, ৫ দশমিক ৬ মাত্রার আরেকটি তীব্র আফটারশক অনুভূত হয়।
তুরস্কে প্রায়শই ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর আগে, ১৯৯৯ সালে উত্তর-পশ্চিম তুরস্কে শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত অঞ্চলে সৃষ্ট ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে হয়। যার শক্তিশালী আঘাত লেগেছে পাশের দেশ সিরিয়াতেও। এ ঘটনায় দুদেশে এখন পর্যন্ত ১ হাজা ২০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ধসে যাওয়া অসংখ্য ভবনের নিচে চাপা পড়েছেন আরও বহু মানুষ। এর মধ্যেই ঘটনার ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়েছেন বেঁচে ফেরা কয়েকজন ব্যক্তি।
তুরস্কের মালত্য শহরের তরুণি ওজগুল কনাকচি (২৫) বিবিসি তুর্কিকে বলেন, ভূমিকম্পের সময় আমি ও আমার ভাই সোফায় ঘুমাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে কম্পন অনুভূত হলে ভাইকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি কাঁপছো। আমার ভাইও আমাকে, একই প্রশ্ন করে। তখনই বুঝেতে পারি, আমরা ভূমিকম্পের কবলে পড়েছি।
ওজগুল আরও বলেন, আমি ঘরের বৈদ্যুতিক বাতির দিকে তাকিয়ে দেখি, সেটি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। পরে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তিন বছর বয়সী ভাতিজাকে নিয়ে আমরা সবাই ঘর থেকে দৌঁড়ে বের হয়ে যাই। পরে আফটার শকের ফলে আমাদের চোখের একটি ভবনের কাচের জানালাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
ভূমিকম্পে আমাদের ভবনটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশেপাশের পাঁচটি ভবন ধসে পড়েছে। অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান চললেও, প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়া ও তুষাপাত পরিস্থিতি খুব কঠিন করে তুলেছে। সবাই এখন রাস্তা ও খালি জায়গাগুলোতে বসে রয়েছেন। কী করবেন, কী হবে তা সবাই খুব চিন্তিত।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের বাসিন্দা সামের রয়টার্সকে বলেন, ভোরের দিকে হঠাৎ ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছবিটি বিকট শব্দে পড়ে যায়। আমি হকচকিয়ে ঘুম েেক উঠে পড়ি। বুঝতে পারি, ভূমিকম্প হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে হুড়মুড় করে বাড়ি েেক বের হয়ে যাই। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় নিজের বাড়িটি মাটিতে মিশে যায়।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে নিহাত আলতুন্ডাগ নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমার চারপাশে ভবনের ধ্বংসস্তপ। সেখানে আগুন লেগেছে। যেসব ভবন টিকে আছে সেগুলোতেও বড় বড় ফাটল। শত শত মানুষ ধ্বংসস্তপের নিচে চাপা পড়েছে, তাদের মধ্যে কত যে শিশু আছে তার ঠিক নেই। তারা বেঁচে আছে কি না, তা আমরা কেউই জানি না।
তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আদানার নিলুফার আসলান নামের এক নারী বলেন, ভূমিকম্পে আমাদের পাঁচতলার অ্যাপার্টমেন্টটি কেঁপে ওঠে। প্রায় ১ মিনিট ধরে পুরো ভবন কাঁপতে থাকে। এ সময় আমি পরিবারের অন্য সদস্যদের এক জায়গায় জড়ো হওয়ার জন্য বলি। আমার মাথায় তখন শুধু একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, মারা গেলে অন্তত সবাই একই জায়গায় একসঙ্গে মরে যাই।
ভূমিকম্প থামলে, দৌঁড়ে বাইরে চলে আসি। এর পরপরই আমাদের ভবনটিসহ আশেপাশের চারটি ভবন ধসে পড়ে। বেরিয়ে আসার সময় আমার সঙ্গে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। সব শেষ হয়ে গেছে। তবে, বেঁচে আছি সেটিই এখন সবচেয়ে ভাগ্যের বিষয়।