Search
Close this search box.

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সকাল এবং পেছনের কথা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সকাল এবং পেছনের কথা

বিভুরঞ্জন সরকার

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন এবং তার আগের দিনটি কেমন ছিল? কিংবা কেমন ছিল ওই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দম্ভ ভরে বলেছিল, তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। কেউ তাদের কিছু করতে পারবে না। সে রকম ব্যবস্থাই করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন, তাদের পালের গোদা খোন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমান, খুনিদের দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। রাজনীতির ইতিহাসে নেতা বা সরকার প্রধানকে হত্যার নজির থাকলেও বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডটি ছিল ব্যতিক্রমী এই কারণে যে, ১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয়েছিল। এমন কি ১০ বছরের শিশু রাসেলও খুনিদের বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি। শেখ মুজিব যদি শাসক হিসেবে ব্যর্থও হয়ে থাকেন, তিনি যদি বাকশাল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে কাঁটা বিছিয়েও থাকেন, তাহলে অভিযোগ হবে তাঁর বিরুদ্ধে, কিন্তু তাঁর স্ত্রী, সন্তান এমনকি নবপরিণীতা পুত্রবধূদের কী অপরাধ ছিল?

না, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করেছিল, এক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে। তিনি ব্যর্থ শাসক ছিলেন না, তিনি গণতন্ত্রের পথ সংকুচিত না করে বরং শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে যাত্রা করেছিলেন। শোষিত মানুষেরাই সংখ্যাগুরু। তাদের মতামত স্বীকৃতি পাওয়াই তো প্রকৃত গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন – পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত। তিনি তাঁর অবস্থান শোষিতের পক্ষে বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। তাই শোষকদের যারা প্রতিনিধি তারা সম্মিলিতভাবেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে তা চরম নৃশংসতার সঙ্গে বাস্ববায়নও করেছিল। তারা যেমন দেশের মধ্যে ছিল, তেমনি ছিল দেশের বাইরেও। বঙ্গবন্ধুকে ঠেকানো বা তাঁকে পরাজিত করার অনেক চেষ্টা হয়েছে। তিনি যখন নিজেকে রাজনীতির জন্য, গণমানুষের পক্ষের রাজনীতির জন্য প্রস্তুত করা শুরু করেন, তখম থেকেই তাঁর বিরোধিতাও আরম্ভ হয়। জেল জুলুম ফাঁসির মঞ্চ তৈরি থেকে কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে দমানো যায়নি, তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন করা যায়নি। ওদের বাঁধন যত শক্ত হয়েছে, তিনি ততই বাঁধন ছিন্ন করার সাহসে বলীয়ান হয়েছেন সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়ে। সত্তরের নির্বাচনে বিপুল জনরায় পেলেও তাঁর হাতে ক্ষমতা না দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধ। সেই যুদ্ধও যখন শেখ মুজিবকে পরাজিত করা সম্ভব হলো না, তখনই হয়তো করা হয় তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার বাস্তব পরিণতি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ঘাতকদের দায়মুক্তি দিয়ে যারা ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবের নাম ইরেজ করে দিতে চেয়েছে, তারা সফল হয়নি। মুজিব ইতিহাসের মহানায়ক হয়েই আছেন। ঘাতকেরা বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু যাদের ফাঁসি হয়েছে, যারা দণ্ডিত হয়ে পালিয়ে আছে, তারাই কি সব, নাকি পেছনে আরও নাম আছে? কারা তারা? তারা কি বিচারের আওতার বাইরে থাকবে? এখানে এসে উত্তর খোঁজার সুবিধার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব, প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খানের একটি লেখা নিচে হুবহু উদ্ধৃত করছি । তোয়াব খান এখনো জীবিত আছেন। এই লেখা নিয়ে কারও কোনো কৌতূহল থাকলে সরাসরি তাঁর কাছে গিয়েও জানতে পারেন। তোয়াব খান লিখেছেন : ‘ ১৫ আগস্টের আগের দিন অর্থাৎ ১৪ আগস্ট দিনটি ছিল ইভেন্টফুল, মানে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছিল ওই দিন। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা জিনিস পরিষ্কার, যা আমি অনেকবার বলেছি বা লিখেছি। ১৫ আগস্ট এক দিনে ঘটেনি। এর পেছনে আরও ষড়যন্ত্র ছিল, সেটা দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। এবং তাতে কারা কারা জড়িত আর সেটা কীভাবে হতে পারে, তা যারা জেনেছেন, বলারও চেষ্টা করেছেন। মুশকিল হচ্ছে, দেশের মানুষের ওপর বঙ্গবন্ধুর খুব বেশি আস্থা ছিল। তিনি মনে করতেন, জাতির পিতাকে কেন কেউ হত্যা করবে? ১৪ আগস্টে ঘটনাটা হচ্ছে এ রকম, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাতে সমাবর্তন বক্তৃতা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি এক্সটেম্পোর বক্তৃতা করব, তোমরা শুধু পয়েন্টগুলো লিখে দেবে। কার্ডে মোটা মোটা অক্ষরে লিখে দেবে, যেন আমার দেখতে সুবিধা হয়।’

সন্ধ্যায় গণভবনে এলেন মোকাম্মেল হক, তিনি তখন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা সচিব। তারপর এলেন ম্যাক স্যার, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, তিনি তখন শিক্ষামন্ত্রী। পরদিন কী হবে না-হবে, তার বিবরণ একটার পর একটা লেখা হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে ছিলেন মাহবুব তালুকদার। তিনি তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রেস সেক্রেটারি। তিনি আমার সহকারী ছিলেন। উনি বঙ্গভবনে আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করতেন। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন তিনি এখানে চলে এলেন।

যা হোক, সবাই মিলে পয়েন্টগুলো লিখে রাখতে লাগল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু মাঝে আমাকে ডাকলেন, ‘আসো এখানে।’ আমিও তখন পয়েন্টগুলো তৈরি করতে নোট নিচ্ছিলাম। আমি মাহবুব তালুকদারকে বললাম, ‘তুমি নোটগুলো নাও, আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আসি।’ যা হোক, সবাই মিলে পয়েন্টগুলো লেখা হতে লাগল। ইতিমধ্যে একটা টেলিফোন এল। ভারতীয় একটা হেলিকপ্টার বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল, সেটা নোয়াখালীর রামগতির কাছে বিধ্বস্ত হয়েছে। বাজারে গুজব যে নিচে থেকে গুলি করে হেলিকপ্টারটিকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখন এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করা এবং কীভাবে এটাকে জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে, সেটা ঠিক করা দরকার। এটা শুধু আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার না, এটা খোদ যিনি রাষ্ট্রপতি এবং জাতির পিতা, তাঁর অনুমোদন দরকার। আমি প্রথমে ঘটনা জানার চেষ্টা করলাম। তখনকার দিনের বিমানবাহিনীর উপপ্রধান খাদেমুল বাশার আমাদের স্কুলের বন্ধু। আমি বাশারকে টেলিফোন করলাম ঘটনাটা আসলে কী, তা জানতে। বাশার আমাকে জানাল, ‘ভারতীয় হেলিকপ্টার যাচ্ছিল। রামগতিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে গেছে। হেলিকপ্টারে যারা ছিল, তাদের লাশ ভারতে হস্তান্তর করার কাজ চলছে।’

আমি এটা জেনে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বললাম, ‘স্যার এ রকম ঘটনা।’ তিনি বললেন, ‘আমি জেনেছি।’ তারপর বললেন, ‘আমরা কী করব নিউজটা নিয়ে?’

এ কথা জিজ্ঞেস করার কারণ হলো, তখন দেশে জরুরি অবস্থা জারি আছে। তাই এ রকম খবর দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন এবং কীভাবে যাবে, সেটাও ঠিক করা দরকার। আমি বললাম, ‘এই নিউজটা কি যাবে?’ এখানে বঙ্গবন্ধুর যে নির্দেশনা, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বললেন, ‘দেখো, ঘটনা চেপে যেও না। জানিয়ে দাও, যা ঘটেছে। এতে আমাদের তো কিছু করার নেই। দুর্ঘটনায় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। আমরা লাশ হস্তান্তরের ব্যবস্থা করছি।’ আমি বঙ্গবন্ধুর ঘর থেকে চলে এসে নিজের জায়গায় বসেছি। লিখছি, এ সময় ভারতীয় হাইকমিশন থেকে ফোন এল: ‘আপনারা নিউজটা দিচ্ছেন কি?’ বললাম, ‘আমরা দিচ্ছি।’

‘দিচ্ছেন? এ সিদ্ধান্তটা কোন পর্যায়ের?’ আমার তখন একটু মনে হলো, এভাবে তিনি প্রশ্ন করছেন কেন? বললাম, ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের।’
ভারতের উদ্বেগের কারণ ছিল। তাদের দেশেও তখন জরুরি অবস্থা চলছিল। এ রকমভাবে বাংলাদেশে তাদের একটা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে, তাতে এত সৈন্য মারা পড়েছে, এই কৈফিয়ত তাদের দিতে হবে তো। যাই হোক, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর টেলিফোন করেছিলেন নিউজটা কীভাবে যাচ্ছে জানার জন্য। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটা হচ্ছে বিএসএস আরেকটা পিআইডি। দু জায়গায়ই বলে দেওয়া হয়েছে। আপনাকে জানাবে।’

এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু এসে আবার বললেন, ‘তোমরা সমাবর্তনের পয়েন্টসগুলো লেখো। পয়েন্টগুলো লেখা হলে তুমি রাতে জানাবে।’
আমরা যখন ওটা তৈরি করেছি, ওই দিন আবার গণভবনে একটা ডিনার ছিল। তখনকার দিনে ডিনার-টিনার এখনকার মতো করা যেত না। আমরা ১০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে এই ডিনারের আয়োজন করেছিলাম মশিউর রহমান, ফরাসউদ্দিন আর মনোয়ার হোসেনের বিদেশযাত্রা উপলক্ষে। তাঁরা হার্ভার্ড আর এমআইটিতে যাচ্ছিলেন ডক্টরেট করার জন্য। তাঁদের বিদায় জানানোর জন্য এই ডিনার। আমাদের সচিব যিনি ছিলেন, একজন হলেন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার সেক্রেটারি আবদুস সাত্তার আরেকজন সচিব আবদুর রহিম। তাঁরা বললেন, ডিনারে থাকতে পারবেন না। তাঁদের গুলশানে এক বাড়িতে দাওয়াত আছে, সেখানে যেতে হবে। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে।’ এরপর বাড়িতে চলে এসেছি। হাতে লিখতে হচ্ছে, তাই সময় লাগছিল। বাসায় বসে পয়েন্টগুলো লিখছি কার্ডে মোটা মোটা অক্ষরে।

এর মধ্যে রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করেছেন, ‘কাল সকালে তাড়াড়াড়ি এসো। আমি এস্কটেম্পোর বক্তৃতা দেব।’ বিভিন্ন সময়ে আগেও বলেছেন, সেদিন সন্ধ্যায়ও বলেছেন, রাত ১২টার দিকেও বললেন, ‘একসময় ঢাকা ইউনিভার্সিটি আমাকে বহিষ্কার করেছিল। এরপর আমি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি।’ বললেন, ‘আমার অনেক রাজনীতির কথাও বলার আছে ওখানে।’ বঙ্গবন্ধুর পয়েন্টসগুলোর মধ্যে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার ছিল। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু ম্যাক স্যারকে বলে দিয়েছিলেন, ‘এই বাংলাদেশে লেখাপড়া হয় কিন্তু গবেষণা হয় না। গবেষণার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দীর নামে।’ আমাকে বললেন, ‘পয়েন্টগুলো ভালোভাবে লিখছ তো?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’
বললেন, ‘কাল সকাল সকাল চলে আসবে। এগুলো একবার দেখব। তারপর ইউনিভার্সিটিতে যাব।’

সকালে যখন গোলাগুলির শব্দ শুনলাম, তখন প্রথমে ধারণা হয়েছিল, নকশালরা গোলমাল করছে কিংবা সিরাজ শিকদারের লোকজন গোলমাল শুরু করেছে। যখন রেডিওতে ঘোষণা হয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সবাই ভেঙে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাত ১২টার দিকে সেটাই ছিল আমার শেষ কথা। পরে যখন অনেক সময় ভেবেছি, ঘটনাটা শুধু এভাবে ঘটল? কয়েকজন বহিষ্কৃত সেনাসদস্য কি তা ঘটাতে পারে? তা তো হতে পারে না। ঘটনার পেছনে কী কী ছিল?

কয়েকটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার বঙ্গবন্ধু একটা ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি দিয়ে বললেন, ‘এটা নাও।’ নিলাম। ‘তোমার কাছে রাখো।’
আমি ওটা পড়তে গিয়ে দেখি, একটা ইয়ং অফিসার্স নামে টাইপ করা। তাতে সিনিয়র অফিসারদের কে কী চরিত্রের লোক, তার ব্যাখ্যা করা আছে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি জানি। এদের প্রত্যেকের চরিত্র জানি। ওটা রেখে দাও।’

আমি এগুলো বাড়ি নিয়ে যাইনি। অফিসেই ছিল। ১৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের গণভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই কী হয়েছে সেই চিঠিটার, তা আর জানা হয়নি।

১৫ আগস্ট সকালে আমার মেয়েরা স্কুলে যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল। ঘটনা শোনার পর আমি লাল টেলিফোনে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করলাম। যাঁরা বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা, নিরাপত্তার জন্য তথ্য সংগ্রহ করেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের টেলিফোন করেছি। এঁদের নাম এখন আর বলব না। তাঁরা মারা গেছেন।
প্রধম যাঁকে ফোন করলাম, তাঁদের একজন বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই তো শুনছি। কিন্তু আমি তো কিছু বলতে পারব না।’
গোযেন্দা বিভাগের প্রধান বলেছেন, ‘শুনছি। দেখি।’

ফরাসউদ্দিন সে সময় বঙ্গবন্ধুর প্রাইভেট সেক্রেটারি-২ ছিল। ওকে ফোন করলাম। ফরাস প্রথম উৎসাহের সঙ্গে জানাল, ‘একদল লোক অভ্যুত্থান করার চেষ্টা করেছিল। জামিল ভাই (কর্নেল জামিল) ওদিকে চলে গেছেন। ৩২ নম্বরের দিকে। আমিও ওখানে যাচ্ছি।’

আমিও উৎসাহিত হলাম। ভাবলাম, অভ্যুত্থার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।

কিন্তু পরে তো জানলাম, জামিল সাহেবকে ওখানেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে মেরে ফেলেছে। ফরাসকে পিটিয়েছে, তারপর বের করে দিয়েছে। আমি যখন ফরাসের কাছে পরে গেলাম, বুঝলাম, খুব ঝুঁকিপূর্ণভাবেই সে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল। একজন বুরোক্র্যাট বা আমলা হিসেবে সে এতটা সাহসের পরিচয় দেবে, সেটা ভাবিনি।

সকালে ছোট ভাই বাচ্চুসহ বের হলাম। দেখতে চাইছিলাম, রাস্তায় লোকজন বের হয় কিনা। মোহাম্মদপুরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। মোদাব্বের সাহেবের রাড়ির কাছে গিয়ে শুনলাম বিহারিরা বলছে ‘এ লোগ ভাগ রাহা হায়।’ ওদের তাড়া করলাম। তখন দেখলাম, গাড়িতে কালো পোশাকের সৈন্য দল। বুঝলাম, আর বাইরে থাকা যায় না। এর মধ্যে এসপি মাহবুবের একটা ফোন এল। লাল টেলিফোনে। তিনি আসলে ফোন করতে চেয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীর সেকেন্ড ম্যান আর্মির কর্নেলকে। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা। লাল টেলিফোন তাঁর কাছে যাওয়ার কথা। এসেছে আমার কাছে। মাহবুব বলছে, ‘আমি চেষ্টা করছি। দেখি কাকে কাকে অর্গানাইজ করতে পারি।’ এসপি মাহবুব তাঁর মতো করে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পেরে ওঠেননি।

বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ ফোন করেছিল। এনায়েতুল্লাহ খান খুব উৎসাহ নিয়ে ফোন করে বলেছে, ‘ইয়ং অফিসাররা দারুণ কাজ করে ফেলল। আপনার চিন্তা নেই, থাকেন।’ ফয়েজ আহমদ ফোন করে বললেন,‘ ঘটনা খুব গোলমেলে, সাবধানে থাকবেন।’ আর কেউ ফোন করেনি। আমি কিছু কিছু ফোন করেছি। যাঁদের জানার কথা, তাঁরা সবাই এমনভাবে কথাবার্তা বলেছেন যে মনে হয়েছে এঁরা প্যাসিভলি বা জেনেশুনে এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেছেন। এখন কয়েকটি কথা মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর দিক থেকে কতগুলো জিনিস বলব। এ রকম ঘটনা তো জানার বা আলোচনা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেউ কেউ কি আগে থেকেই জানত?

১৫ আগস্টের ঘটনার আগে জুন মাসের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। ৭ জুন বাকশালের একটা সরকারি ঘোষণা হলো। এখন যেখানে ডিএফপি অফিস, সেখানে আগে ছিল একটা অফিস, যেখানে আওয়ামী লীগ অফিস করল। বৃষ্টির মধ্যে সেখানে হাজারে হাজারে মানুষ দল বেঁধে বাকশালে জয়েন করতে এসেছিল। কাজ শেষ করে বঙ্গবন্ধু বাড়ি চলে এলেন। সঙ্গে এলাম আমি, হানিফ আর মহিউদ্দিন। বাড়িতে এসে বঙ্গবন্ধু তিনতলায় বসতেন। ওখানে বসে বারান্দামতো যে জায়গাটা আছে, সেখানে আলোচনা করতেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে সেখানে রেখে নিচে এসে দেখি জিয়াউর রহমান বসে আছেন। বললাম, ‘আরে আপনি এখানে!’ জিয়াউর রহমান বললেন, ‘দেখেন তো তোয়াব সায়েব। বাকশালে আমার নাম নেই। এটা কী রকম কথা। আমি কেন বাকশালে থাকব না?’ বললাম, ‘দেখা করবেন?’ বললেন, ‘হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুকে বলার জন্য এসেছি।’ বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, জিয়াউর রহমান এসে বসে আছেন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘নিয়ে আস তারে।’ আমি জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর কাছে দিয়ে চলে এসেছি।
ব্যাপার হচ্ছে, পরবর্তীকালে বিভিন্ন ডকুমেন্ট আমি পড়েছি। তাদের মধ্যে একজনের কথা পড়েছি, যিনি ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। চট্টগ্রামের একজন। জুলাই মাসের দিকে জিয়াউর রহমানকে জিডিআরের (তখনকার পূর্ব জার্মানি) অ্যামবাসেডর করে পাঠানোর কথা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান এক মাস সময় চেয়েছেন। বিভিন্ন লেখায় এ বিষয়টা দেখেছি। এক মাস সময়। তখন জুন মাস। ঘটনাগুলো মেলালেই বোঝাই যায়।
১৫ আগস্ট-সংক্রান্ত দুটো বাক্য স্মরণীয় হয়ে থাকা উচিত। একটা হলো, একজন বঙ্গবন্ধুকে বলছেন ‘আপনি পালাতে পারেন নাকি দেখেন।’ বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার খবর পেয়ে বলা আরেকটা বাক্য, ‘সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার।’ সব বাদ দিলাম। অসাংবিধানিকভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে! সে কথাটাই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ