Search
Close this search box.

ডেঙ্গু আবারও লাগামহীন!

ফিরোজ মান্না 

দেশে প্রতিদিন হু হু করে বড়ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টায় নতুন  রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৫৩ জন। সোমাবার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৩৯ জন। হাসপাতালে ভর্তি ১৫৩ জন নতুন রোগীর মধ্যে ১০৭ জন ঢাকার এবং ঢাকার বাইরের ৪৬ জন। এছাড়া চলতি বছরে এপর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৯ জন। আর আগস্ট মাসে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ১১২ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৫১৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছেন ৪৩০ জন,আর বাকি ৮৬ জন ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ৪ হাজার ৭৭২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং ছাড়া পেয়েছেন ৪ হাজার ২৩৭ জন।

সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন মৌসুম ধরা হয়। কারণ, এ সময় বৃষ্টিপাতের কারণে পানি জমে। সে পানিতেই এডিস মশার প্রজনন ঘটে। এডিস মশার প্রজননের ক্ষেত্র যেহেতু পানি, তাই এ সময় আমাদের চারপাশে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর বংশ বিস্তার বেশি হয়। তবে উল্লেখ্য যে, সব পানিতেই এডিস মশা জন্মায় না। নর্দমা, কূপ, পুকুর, লেক, নদী বা মাটির আধারে ডিম পাড়ে না এডিস মশা। এসব জায়গায় যে মশা দেখা যায়, তা এডিস নয়। এই মশা জনগণের আবাসস্থল নয়তো নির্জন ও পরিত্যক্ত জায়গায় জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে জন্ম নেয়। তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার প্রজনন বন্ধ করা আর মশা নির্মূলের কোনো বিকল্প নাই। পানি জমতে পারে এমন কোনো অবস্থাই যেন না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সকল প্রকারের ডাবের খোসা, নারিকেলের মালা, পুরাতন টায়ার, চিপসের খালি প্যাকেট, ছাদের উপরে জমে থাকা পানি ইত্যাদি সবই সরিয়ে ফেলতে হবে নিজ উদ্যোগে। কেননা কীটতত্ত্ববিদের তথ্যমতে, এডিস মশা ডিম পাড়ার পরে এক বছর পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। কোনো পাত্রে এডিসের ডিম থাকলে তার অপসারণ না করলে এক বছরের মাথায় পানির স্পর্শ পেলে ডিম ফুটে বাচ্চা হতে পারে। পানি জমে মশার বংশবৃদ্ধি যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে।

রাস্তাঘাটের আশপাশে, নালা ও নর্দমায় যাতে পানি জমতে না পারে, সেজন্য সিটি কর্পোরেশনকে আরো সজাগ ও সচেতন হতে হবে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু নিমূলের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। একসময় দেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল খুব বেশি, যার বাহকও মশা। সেই ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে এসেছে সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক কাজ করার জন্য। অন্য মশা ও মশাবাহিত রোগ যেমন কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সিটি কর্পোরেশনও বসে নেই। মশা ও এডিসের লার্ভা শনাক্তে অত্যাধুনিক ড্রোনের মাধ্যমে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

গত ২ জুলাই থেকে শুরু হওয়া জরিপে এখন পর্যন্ত মোট ৭৭৮৬টি বাড়ির ছাদ, ১৩৪৩টি ছাদ বাগানে ড্রোন জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২৮টি ছাদে জমা পানি পাওয়া যায় এবং ৫টি বাড়ির ছাদে এডিসের লার্ভা শনাক্ত করা হয়। বাড়ির মালিকদের সতর্ক করে দেওয়া হয় এবং লার্ভা পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নগরবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। জনবহুল এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রতিটি স্থাপনা নজরদারিতে আনা সম্ভব নয়। শনাক্ত হলে জরিমানা হবে, কিন্তু এটাই সমাধান নয়। সকলকে তার নিজ নিজ আবাসস্থল পরিস্কার রাখতে হবে। কোথাও কোনো প্রকার পানি জমা তাকে এমন জায়গা চোখে পড়লে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। প্রতি বছরই দেশে ডেঙ্গুর কম-বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

বিশেষ করে, ঢাকা শহরে এর প্রাদুর্ভাবটা একটু বেশি লক্ষ করা যায়। বিগত কয়েক বছরে ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর মারাত্মক রূপ ধারণ করতে দেখা গেছে। তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম বেশি হওয়ার পিছনে এর ভেরিয়েন্টের একটি দায় আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিসিএসআইআর’র উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলো হলো: ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪। দেশে ডেনভি-৩ শনাক্ত হয় ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালে ডেনভি-৩ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং সবশেষে ২০১৯ সালে মহামারি আকার ধারণ করে এটি। ডেঙ্গুর প্রকোপ দেশে বড় আকারে দেখা দেয় ২০০০ সালে। ওই বছরে ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় আর মৃত্যুবরণ করে ৯৩ জন। কিন্তু তার চেয়েও কয়েক গুণ ভয়াবহ আকার দেখা দেয় ২০১৯ সালে। সরকারি হিসাবে ওই বছরে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে ১৭৯ জন। ইতিহাসের সর্বাধিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ওই বছর। আর আক্রান্ত ও মৃত্যুর অধিকাংশই ঘটে ঢাকায়। সারাদেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, তার অর্ধেকই ছিলো ঢাকায় এবং এখানে মৃত্যুর হার ছিল মোট মৃত্যুর ৭৭ শতাংশ। করোনাকালীন ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কম থাকলেও ২০২১ আবারও দেখা দেয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা। ২৮ হাজার ২৬৫ জন আক্রান্ত ও ১০৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ওই বছর।

তবে বিগত কয়েক বছর ডেঙ্গুতে বেসামাল অবস্থা তৈরি হলেও এখনো পর্যন্ত এডিস নির্মূলে টেকসই উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা গতানুগতিক এবং খুব একটা যে কার্যকরী তা বলা যাবেনা। এর জন্য আরো গবেষনা প্রয়োজন। টেকসই সমাধান অতীব জরুরী। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়।

তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চলতে হবে। যাতে ডেঙ্গুজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়। ডেঙ্গু রোগীর প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরে প্রধান চিকিৎসা হলো ফ্লুইড রিপ্লেসমেন্ট বা তরল ব্যবস্থাপনা। পানির সঙ্গে খাওয়া যেতে পারে ওরস্যালাইন, স্যুপ, ডাবের পানি, ফলের শরবত, ভাতের মাড়, দুধ ইত্যাদি। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশ্রাম খুব গুরুত্বপূর্ণ।

রোগীদের শারীরিক দুর্বলতাটাও থাকে অত্যধিক। উপসর্গের ৭ থেকে ১০ দিন ভারী কাজ, মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করা যাবে না। রোগী স্বাভাবিক হাঁটাচলা, দৈনন্দিন কাজ করতে পারবেন। এবং বাড়িতে অবস্থান করে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। ডেংগু হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না। প্রাইমারি কেয়ার সেন্টার বা আপনার নিয়মিত চিকিৎসকের চেম্বারে গেলেই চলবে। তিনি রক্তের রিপোর্ট, শারীরিক পরীক্ষা, ব্লাড প্রেসার, পালস ইত্যাদি পরীক্ষা করে তবেই সিদ্ধান্ত দেবেন ভর্তি হবেন কি হবেন না। নিজে নিজে হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হবার জন্য চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই। প্রায়শই দেখা যায় প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়। এগুলো খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গুতে প্ল্যাটিলেট শরীরে দেওয়া খুব কমন ট্রেন্ড হলেও আসলে খুব কম ক্ষেত্রেই প্ল্যাটিলেট লাগে। দিলেও কাজে লাগে কিনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ ব্যাপারে ডাক্তারকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন। রোগীর পক্ষ থেকে প্রভাবিত করা উচিৎ না। আবার প্লাটিলেট কমে গেলেই আতংকিত হয়ে প্ল্যাটিলেট দিচ্ছেন না কেন বলে পীড়াপীড়ি করাও সমীচিন নয়। প্রেসার,পালস, হিমাটোক্রিট বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তবে ডেঙ্গু শনাক্ত হলে কোনভাবেই হেলাফেলা করা যাবেনা। জ্বর কমে গেলে ভাল হয়ে গেছে ভাবার কারণ নেই। কেননা জ্বর ছেড়ে যাবার পরই ক্রিটিক্যাল পর্যায় শুরু হয়। তাই অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। বর্ষাকালে ডেঙ্গুর কথা মাথায় রাখতে হবে। যেকোনো জ্বর হলে অবহেলা করা যাবে না। ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সেরে যায়। তবে পরিস্থিতি জটিল হলে সুস্থ হতে দুই-তিন সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। শুরুতেই সচেতন হলে মৃত্যুঝুঁকি ও অন্যান্য জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তাই সচেতনতা এবং সচেতনতাই একমাত্র প্রতিষেধক।

লেখকঃ সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক পথে প্রান্তরে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ