স্টাফ রিপোর্টার- পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ব্রুনাই দারুসসালামের সুলতান হাজী হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দীন ওয়াদ্দৌলার প্রথম বাংলাদেশে সফর দুই দেশের মধ্যে চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রথমবারের বাংলাদেশ সফরে আসা সুলতানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সাক্ষাৎকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
সুলতানকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই শুভ সফরের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং পারস্পরিক সুবিধার জন্য অব্যবহৃত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
মোমেন পেশাদার ও দক্ষ মানবসম্পদসহ ব্রুনাইতে প্রয়োজনীয় বাংলাদেশি কর্মী সরবরাহের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতের কথা জানান।
সুলতান ব্রুনাইয়ে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমী ও আন্তরিকতার প্রশংসা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা তুলে ধরে মোমেন বাংলাদেশে মহামারি কোভিডের সফল মোকাবিলাও ব্যাখ্যা করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সুলতানকে জানান, বাংলাদেশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করার জন্য প্রস্তুত এবং বাংলাদেশে ব্রুনাইয়ের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেছে।
শনিবার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় এসেছেন ব্রুনাই দারুসসালামের সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদ্দৌলাহ। দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায় তাকে বহনকারী বিশেষ বিমান। রবিবার প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও একান্ত বৈঠক করেন তিনি।
বিমানবন্দরে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ ব্রুনাইয়ের সুলতানকে আন্তরিক সংবর্ধনা দিয়ে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। চলমান করোনা মহামারী বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। বিমান থেকে নামার সময়ে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয় সুলতানের সম্মানে। তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা জানানো হয়। সুলতান হাসানাল বলকিয়াহকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপ্রধান আবদুল হামিদ।
পরে দুই রাষ্ট্রপ্রধান অভ্যর্থনা মঞ্চে ওঠেন। সুলতানকে গার্ড অব অনার দেয় তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল। এ সময় ব্রুনাই ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। এরপর গার্ড পরিদর্শন করেন ব্রুনাইয়ের সুলতান বলকিয়াহ।
বিমানবন্দরে অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, সুলতানের সঙ্গে ব্রুনাইয়ের রাজপরিবারের সদস্য, দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, ব্রুনাই সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে এই প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের উত্তর উপকূলে স্বাধীন ইসলামি সালতা ব্রুনাইয়ের সুলতান ঢাকা সফরে আসলেন।
বিমানবন্দর থেকে একটি সুসজ্জিত মোটর শোভাযাত্রা সহকারে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে রওনা দেন দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসা সুলতান বলকিয়াহ। এরপর ব্রুনাইয়ের সুলতান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সুলতান সেখানে একটি গাছের চারা রোপণ এবং দর্শনার্থী বইয়ে সই করেন।
সাভার থেকে তিনি সরাসরি ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠেন। সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সুলতানের সঙ্গে দেখা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে সাক্ষাত করেন সুলতান। তিনি বঙ্গভবনের গ্যালারি হলে দর্শনার্থী বইয়ে সই করেন। পরে সাতটা ৩৫ মিনিটে তাঁর সম্মানে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেন ।
সফরের শেষ দিন রবিবার সকাল সোয়া ১০টায় সুলতান ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে তিনি সেখানে রক্ষিত দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন। জাদুঘর প্রাঙ্গণে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যরা সুলতানকে অভ্যর্থনা জানান।
বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে ব্রুনাইয়ের সুলতান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ের শিমুল হলে একান্ত বৈঠক করেন। পরে চামেলী হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠক হয়। দুই নেতার উপস্থিতিতে চুক্তি ও সমঝোতায় সই করেন দুই দেশের সংশ্লিষ্টরা। সুলতান সেখানে দর্শনার্থী বইয়ে সই করেন।
সূত্র জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে এক ধাক্কায় জ্বালানির দাম গড়ে ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় প্রথাগত বাজারের বাইরে ভিন্ন উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জ্বালানি বাণিজ্যে আগ্রহ দেখিয়েছে ব্রুনাই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ব্রুনাই তাদের ২০৩৫ ভিশন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে চায়, যার মাধ্যমে তাদের মেগা প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করতে পারে। তবে বাংলাদেশ নিরাপদ, নিয়মতান্ত্রিক এবং নিয়মিত অভিবাসনের ক্ষেত্রে ব্রুনাইকে মত দিয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে চিকিৎসক ও নার্সের প্রচুর সংকট রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে সেখানে পেশাজীবী রপ্তানির। একইসঙ্গে দেশটিতে বাংলাদেশের কোনো সরাসরি ফ্লাইট নেই। ফলে অন্য দেশে ট্রানজিট নিয়ে সেখানে যেতে হয়। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল সমঝোতা স্মারক সই হলে শ্রম রপ্তানিতে এ ক্ষেত্রে খরচ কমে আসবে। ফলে শ্রমিক রপ্তানি, সরাসরি ফ্লাইট চালু এবং জ্বালানি বিষয়ে এ সফরে গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উভয় দেশই এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুলতানের আমন্ত্রণে ব্রুনাই সফর করেন। সেই সফরে ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। ১৯৮৪ সালে ব্রুনাইয়ের স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।