গতবছর শনাক্ত এইডস রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৭৬১
গেলো এক বছরেও এইচআইভি শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী
সংক্রমণ বেশি মধ্যপ্রাচ্য ফেরত ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও উদ্যোগের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
স্টাফ রিপোর্টার- কক্সবাজারের টেকনাফের সামলাপুর এলাকায় সাবেকুন্নাহার (৩২)। প্রতারক প্রবাসী স্বামীর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে তিনি ১৫ বছর ধরে এইচআইভি/এইডস রোগের জীবাণু বহন করছেন।
প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে সাবেকুন্নাহার জানান, ২০০৬ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে সৌদি ফেরত প্রবাসী নুরুল হক নামে একব্যক্তির সাথে পারিবারিকভাবেই তার বিয়ে হয়। বিয়ের আগে নুরুল হক সৌদি আরবে ছিলেন। তথ্য গোপন করে বিয়ে করার দু’মাস পর জানতে সাবেকুন্নাহার জানতে পারেন তার স্বামী এইচআইভি পজিটিভ। ইতোমধ্যে স্বামীর মাধ্যমে সেও সংক্রমিত হয়েছে বলেও পরীক্ষায় ধরা পড়ে। এরপর ছয় মাস সংসার করার নুরুলের প্রতারণার ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে নারী নির্যাতন ও পারিবারিক আইনে মামলা করা হয়। পর ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের।
এ ঘটনার বছরখানেক পর সবকিছু জানার পরও সাবেকুন্নাহারকে ভালোবেসে বিয়ে করেন পাশের গ্রামের ব্যবসায়ী সিদ্দিক আহমদ। তাদের সংসারে ১৪ বছরের একটি ছেলে সন্তানও আছে। তবে তার স্বামী ও ছেলে দুজনই এইচআইভি নেগেটিভ। বিয়ের কয়েকবছর পর সিদ্দিক ওমানে চলে যায়। কিন্তু পরিবারের উস্কানিতে কয়েক বছর ধরে স্ত্রী-ছেলের ভরণ-পোষণ করছে না। যোগযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। তাকে তালাক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করার পাঁয়তারা করছে। সরকারি সেবা বলতে শুধু ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও, ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছেন তিনি।
সাবেকুন্নাহারের মতোই প্রতারণা শিকার বা শিরায় ইনজেশনসহ নানা কারণে বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার এখনো উর্ধ্বমুখী। জাতিসংঘের এইডস-বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইডসের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি; যা মোট জনসংখ্যার ০.১ শতাংশ। তবে চিকিৎসা সেবার আওতায় রয়েছে মাত্র ৮ হাজার রোগী।
আর এইচআইভি শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৭৩২ জন। দেশে এইডসে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে মোট ১ হাজার ৫৮৮ জনের। মৃত্যুর হার ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এমন প্রেক্ষাপটে আজ বিশ^ব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ^ এইডস দিবস। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য- অসমতা দূর করি, এইডস মুক্ত বিশ্ব গড়ি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক এবং টিবি-লেপ্রোসি ও এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. খুরশীদ আলম সংবাদ সারাবেলা’কে জানিয়েছেন, ‘সংক্রমণের হার কম হলেও ঘনবসতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং অসচেতনতার কারণে এদেশে এইচআইভির ঝুঁকি বেশি। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমারসহ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এইচআইভি সংক্রমণের হার অনেক বেশি হওয়ায় ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
সরকারের গৃহীত কর্মসূচির আওতায় এইডস রোগীদের চিকিৎসার আওতা বাড়ানো হয়েছে। নেওয়া হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আশা করা হচ্ছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে ২০৩০ সাল নাগাদ ৯৫ শতাংশ এইডস রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশে এইডস আক্রান্ত রোগী বেড়েই চলেছে। নতুন রোগীদের বড় অংশই অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্য।
এছাড়া সংক্রমণ বেশি মধ্যপ্রাচ্য ফেরত ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে। আগে ঝুঁকিপূর্ণ চার ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন রোগী বেশি পাওয়া গেলেও গত বছর সাধারণ মানুষের মধ্যেও বেড়েছে সংক্রমণ। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সর্বশেষ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ হাজার ১০৪ জনকে চিকিৎসা সুবিধার আওতায় আনা গেছে। বাকি ১ হাজার ১২৫ জন সংক্রমিত ব্যক্তি এখনো চিকিৎসার বাইরে আছেন। তবে বাংলাদেশের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল বিভাগ দাবি করছে, আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসার হার প্রতিবছর বাড়ছে।
বাংলাদেশের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল বিভাগ জানিয়েছে, আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসার হার প্রতিবছরই বাড়ানো হচ্ছে। তবে শনাক্ত রোগীর হার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় চিকিৎসার আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি জনসচেতনা বাড়ানো এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া আক্রান্ত দরিদ্র রোগীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করারও পরামর্শ তাদের।
প্রাণঘাতী এ রোগ নিরাময়ে সরকারকে আরও বেশি পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং আওতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, অভিবাসী, পুশব্যাক হওয়া লোকজন এবং এইডসপ্রবণ এলাকাগুলোর দিকে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। করোনা পরীক্ষার মতোই সীমান্ত এলাকায় সবাইকে এইচআইভি টেস্টের আওতায় আনার পক্ষেও মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইউনিসেফ এর তথ্য বলছে, এইডস-সম্পর্কিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হতে পারে। এইচআইভি প্রতিরোধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রকল্পে বাড়তি বিনিয়োগ করা না হলে প্রতিদিন ৭৬ জন কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হবে। সংস্থাটির ‘শিশু, এইচআইভি ও এইডস: ২০৩০ সালের বিশ্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা বজায় থাকলে এইচআইভিতে আক্রান্ত ০-১৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক ২ লাখ ৭০ হাজারে পৌঁছাবে, যা বর্তমানের অনুমানের চেয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম।
সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশেও এইডসের বর্তমান পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর থেকে প্রতিবছর ১০, ২০, ১০০ বা ২০০ জন করে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে নতুন রোগী বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬৯ জনে। ২০০০ সালে প্রথম এইচআইভিতে আক্রান্ত এক রোগীর মৃত্যু হয়।