Search
Close this search box.

বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়ায় একদিন

শীলা প্রামাণিক- ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অমূল্য দলিল। বাঙালির জন্য তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে ফেব্রুয়ারি বাংলার দুখী মানুষের বন্ধু বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতাকে জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ চিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দৃঢ় মনোবল এবং সর্বস্তরের বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে তিনি বাঙালিকে উপহার দিলেন একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। আর বাঙালি তাঁকে বরণ করে নিলো জাতির পিতা হিসেবে। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ভীষণ ভয় পেত। যে কারণে তাঁকে বারংবার কারারুদ্ধ করা হয়। তবে জেলখানায় বন্দি রাখলেও পাকিস্তানি সরকার তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে পারেনি। ইতিহাসের মহানায়ক বাংলাদেশের স্থপতি ‘বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক’ জাতির জনকের জীবন দর্শন সম্পর্কে জানবার কৌতুহলের কোনো অন্ত নেই। যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে, ভালোবাসে জন্মভূমিকে, ভালোবাসে মাা মাতৃভূমিকে, তারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে। তারা জাতির জনকের মহান ত্যাগ অকপটে স্বীকার করেন। সেই মহানায়ক, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা দেশকে ভালোবেসে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে তুলেছিলেন।

যিনি দেশকে বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য বারংবার কারাবাস করেছেন। সন্তান-সন্ততি পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে দেশের জন্য নিজেকে নিবেদন করেছেন। বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেছেন

“রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, তবু দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব।” উচ্চারণ করেছেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

তিনি কেবল একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়ে একটি পতাকা বা মানচিত্রই নয়, বঙ্গবন্ধু এ জমিনের মানুষকে তাদের শোষণ বঞ্চনা থেকেও মুক্তি দিয়েছেন। সেই মহামানবের পবিত্র জন্মভূমি টুঙ্গিপাড়া একবার নিজের চোখে না দেখলে যে জীবনের অপূর্ণতা থেকে যায়! মন-প্রাণ কী যেন খুঁজে বেড়ায় সারাক্ষণ! অবচেতনেই মনটা ভারী হয়ে আসে, উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তাই একদিন স্থির হলো সেই পবিত্র ধাম অবলোকনের দিনক্ষণ। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি চৌবাড়ী ড. সালাম জাহানারা কলেজের সহকর্মী, গভর্নিংবডির সদস্যবৃন্দ, সম্মানিত কিছু সংখ্যক অতিথিসহ সিরাজগঞ্জ থেকে রাত এগারোটার দিকে রওনা দিলাম টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে। পথে ঢাকায় যাত্রা বিরতির পর ঢাকা মাওয়া হাইওয়ে যখন গাড়ি ছুটে চলল তখন মনে হলো এটা কী বাংলাদেশ! রাস্তার চারিপাশের দৃশ্য অবলোকন করে কেউ বিশ্বাস করবে না এটা বাংলাদেশ। মনে হচ্ছিল যেন কোনো উন্নত বিশ্বের বাসিন্দা আমরা।

ঢাকা থেকে কিছু সময়ের মধ্যেই সকাল ছয়টার দিকে পদ্মা সেতুর পূর্বপাড়ে পৌঁছে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অতিক্রম করলাম স্বপ্নের পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতু পাড়ি দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার দিকে। প্রায় দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম টুঙ্গিপাড়ায়। টুঙ্গিপাড়া শেখ রাসেল শিশু পার্কে বাস থেকে নামলাম। তারপর কিছুটা রাস্তা পায়ে হেঁটে সহকর্মী আলপনা ভৌমিকের নেতৃত্বে –“যদি রাত পোহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই” সেই বিখ্যাত গানটি গাইতে গাইতে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের নিকটে পৌঁছে গেলাম। সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধাভরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মাজারে গিয়ে সহকর্মী মো. আব্দুল মান্নানÑএর পরিচালনায় মোনাজাত সম্পন্ন করা হয়। মোনাজাত করার সময় বুকফাটা প্রগাঢ় কান্নায় গলা জড়িয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল এইখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের প্রাণের মানুষ, অত্যন্ত আপনজন, প্রিয়জন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশেষে চোখের জল মুছতে মুছতে নিজেদেরকে সামলে নিয়ে একে একে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘুরে দেখলাম। সমাধি কমপ্লেক্সর পাশেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। সেই পালঙ্ক সেই সোফা চেয়ার টেবিল সব যেন তাঁর শূন্যতার কথা বারংবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। পাশেই চমৎকার স্থাপত্যের একটি মসজিদ। বিশাল এলাকা জুড়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্স যা দেখে বিমুগ্ধ হয়ে পড়লাম। রয়েছে একটি পাঠাগার অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স সরকারি বিশেষ গণগ্রন্থাগার ও জাদুঘর। গণগ্রন্থাগারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বইসহ প্রায় ৬ হাজার বই রয়েছে। রয়েছে গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনীকেন্দ্র, উন্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটোরিয়া, বকুলতলা ও স্যুভেনির কর্নার।

প্রদর্শনীকেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের নানা পর্যায়ের আলোকচিত্র ছাড়াও রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম, মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রামের নানা পর্যায়ের দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র। রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে বহন করা কফিন। সেখানেও আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। প্রদর্শনীর উপর লেখা আছে বিক্ষুব্ধ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি-“জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন।” “মুক্তিযুদ্ধের হাজারো স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল আমাদের আপামর জনগণ কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন তার জ্বলজ্বলে দৃশ্যপট। আছে পঁচাত্তরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নির্মম চিত্র। প্রত্যেকটি স্মৃতি বাংলাদেশের ইতিহাস স্পষ্টভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ইতিহাস এক দিনের নয়, বহু বছরের সাধনার, ত্যাগের ইতিহাস। এই ইতিহাস জাতির পিতার মহান ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখো বীর সন্তানের আত্মত্যাগের ইতিহাস।

আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাস। কারো করুণার দান নয়, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা এই ইতিহাস। এই ইতিহাস কখনো ভোলার নয়। গণগ্রন্থাগারে রেজিস্টার বইয়ে স্বাক্ষর করলাম। এরপর বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সে পাবলিক প্লাজা ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বইটি সংগ্রহ করলাম। সাথে বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত আটটি ব্যাচও সংগ্রহে রাখলাম। সবশেষে শেখ রাসেল শিশু পার্ক পরিদর্শন করে ফিরে এলাম। এখানে টুঙ্গিপাড়ার অবস্থান উল্লেখ করা প্রয়োজন। টুঙ্গিপাড়া বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। যা একটি পৌরসভা ও পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এটি ঢাকা বিভাগের অধীন গোপালগঞ্জ জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে একটি এবং এটি গোপালগঞ্জ জেলার সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। এই উপজেলার উপর দিয়ে মধুমতি নদী ও বাঘিয়ার নদী প্রবাহিত। বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়ার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি ঘুরে দেখার সাথে সাথে বাড়ির জানালার গ্রিল, সিঁড়ির রেলিং, বঙ্গবন্ধুর ছবির ফ্রেমে আলতো হাতে ছুঁয়ে সমুদ্রের মতো গভীর, আকাশের মতো বিশাল উদার এবং হিমালয়ের মতো উঁচু সেই মহামানবের হৃদয়টা অনুভব করবার চেষ্টা করি। এমন মহামানবের স্মৃতি বিজড়িত ধাম পরিদর্শন করতে পেরে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করছি।

এর মধ্যে দিয়ে জীবনের অনেক অপূর্ণতা যেন পূর্ণতা পেল। অবশেষে হাজারো স্মৃতির এ্যালবাম সঙ্গে করে ঘুরে এলাম টুঙ্গিপাড়া। ঘুরে এসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স সরকারি বিশেষ গণগ্রন্থাগারে সংরক্ষনের জন্য আমার লেখা তিনটি কাব্যগ্রন্থ–১. আমার হৃদয় দহন, ২. মেঘের ভাঁজে লোনাজল ও ৩. উৎকলিকা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলাম। তাতেও আরেক সার্থকতার স্বাদ আস্বাদন করলাম। গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে নির্জন নিরিবিলি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার আশেপাশের গ্রাম, ধানখেত, নদী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে মোহিত করবে নিশ্চিত। নির্দ্বিধায় বলা যায় এমন মাটির সন্তানই তো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।

লেখক- সহকারী অধ্যাপক

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ