ড. মিল্টন বিশ্বাস ॥ শহিদ মিনারে প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে সর্বস্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে শায়িত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়। এসময় ভিউগলে করূণ সুর বেজে ওঠে। উপস্থিত মানুষের মধ্যে নীরবতা ও শোকের ছায়া নেমে আসে। ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালির শ্রেষ্ঠ বাতিঘর, আমাদের পথ নির্দেশক, দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক, গীতিকার, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কফিনে শায়িত। জ্যৈষ্ঠে শহিদ মিনার ও আশেপাশে এলাকা রক্তলাল হয়ে হয়ে আছে যেন ভাষা শহিদদের চোখ হয়ে তারা তাকিয়ে আছে কীর্তিমান মানুষটির দিকে। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংগ্রামের স্মৃতিমাখা আঙিনায় তিনি এসেছে মরদেহ হয়ে। আর ফিরবেন না লন্ডন প্রবাসের জীবনে। তাই প্রকৃতির দীপ্য তেজ। সবুজের সমারোহে প্রচ্ছন্ন শোকের মাখামাখি। যেন সার্থক হলো তাঁর অমর একুশের গানটি রচনার পটভূমি।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। যৌবনেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম সারথি হয়ে ওঠেন। সেসময় থেকেই পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও লেখালেখির শুরু। তিনি দুর্দান্ত এক বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি তাঁর যে কমিটমেন্ট ছিল সেটা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আর কয়জনার আছে তা আমার জানা নেই। তাঁর লেখনির মধ্যে, তাঁর বলার মধ্যে, মানুষকে অনুপ্রেরণার মধ্যে তিনি ছিলেন অভাবনীয় একটি ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কলামিস্ট, তিনি ছিলেন জাতির বিবেক ও জাতির বাতিঘর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পের সঙ্গে পরিচয় নব্বই দশকে। কিন্তু তার আগে যখন আমরা স্কুলে পরতাম তখন থেকেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির সাথে পরিচিত ছিলাম। আমরা এও মনে করি মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যদি বাংলাদেশে থাকতেন তখন তিনি নিশ্চিত ভাবেই শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য হতেন। কারণ তাঁকেও সেসময় রাজাকার-আলবদররা হয়তো মেরে ফেলত। তিনি যে পথ অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং প্রবাসে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে কাজ করেছিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে কলাম লিখেছিলেন সেগুলো ছিল স্মরণীয় ঘটনা। আমাদের বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, ঠিক তেমনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর সৃষ্টি কর্মের জন্য, ভাষার আবেগকে কাব্য রূপ দেওয়ার জন্য। সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যে কলাম লিখতে শুরু করেছিলেন সেটা ছিল সাংবাদিকতার একটি ফল। যা ছিল প্রগতির রূপরেখা নির্মাণের নতুন উদ্যম। তাঁর দেখানো পথেই বর্তমান ও ভবিষ্যতের কলামিস্টরা পথ হাঁটবে। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।