ড. মিল্টন বিশ্বাস
আবার এসেছে ১১ জুন। জুন মাসটি নানা কারণে ঐতিহাসিক। ৭ জুন ৬ দফা দিবস, ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২৫ জুন পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন। সবগুলো দিবসের কেন্দ্রে আছেন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা। বিশেষত ২৫ জুনের ঐতিহাসিক ক্ষণটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের জন্য যেমন, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বাঁক বদলের দিন হিসেবে স্মরণীয় হতে যাচ্ছে। আর এই অনন্য সাহসী কাজটি সম্পন্ন হওয়ার জন্য জননেত্রীর দূরদৃষ্টিময় নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই নেতৃত্ব দ্রুত সাফল্য নিয়ে এসেছে ১১ জুনের ঘটনার পর। আসলে ২০০৮ সালের ১১ জুন রাজবন্দি শেখ হাসিনার কারা-মুক্তি এদেশের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে সেনাসমর্থিত মেয়াদোত্তীর্ণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। দীর্ঘ প্রায় ১১ মাস কারাভোগের পর এই দিন সাবজেলের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হন তিনি। কারাগারের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দেয়ার দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ক্রমাগত চাপ, আপসহীন মনোভাব ও অনড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মু্ক্িত দিতে বাধ্য হয়।
মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দি করা হলেও শেখ হাসিনার ২০০৭ সালের ৭ মে আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তন ছিল আমাদের জন্য মঙ্গলকর। ওই বছর ১১ জানুয়ারির পর তাঁর দেশে ফেরার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু তাঁকে রাজবন্দি করার পর সেসময় গণমানুষ তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিল; দেশকে নেতৃত্ব শূন্য করার চক্রান্ত স্পষ্ট হয়েছিল। তাঁর সাবজেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেফতারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃত্যুবরণ, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে বিহ্বল ও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। কারণ সে সময় আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত; বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সত্যকথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। আসলে ২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক নাটকীয় ঘটনার জন্ম হয়েছে। সেসময় ‘দুদকে’র দৌড়ঝাপ, ‘মাইনাস টু’র কুশিলবদের উচ্চস্বর ও দাম্ভিকতা, বিচারকদের অসহায়ত্ব আর শেখ হাসিনার জন্য জনগণের বেদনাবোধ অন্যান্য দেশের মানুষকে আলোড়িত করেছিল। শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য দেশ-বিদেশে যে জোরাল দাবি উঠেছিল তা ছিল অভূতপূর্ব। অন্যদিকে দলের সভাপতিকে গ্রেফতারের পর থেকেই আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবর্গ বিভিন্নভাবে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। শেখ হাসিনাকে মুক্তি দেয়া না হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে স্লো পয়জনিংয়ের কারণে ওই সময় কারাগারের অভ্যন্তরে নেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দেয়ারও দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও রাদওয়ান ববি বিদেশি আইনজীবীদের সহায়তায় মামলা লড়েন এবং নেত্রীর মুক্তির বিষয়ে জনমত গঠন করেন। আওয়ামী লীগের ক্রমাগত চাপ, আপসহীন মনোভাব ও অনড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ফলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগষ্ঠিতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করা হয়। অবসান ঘটে বিএনপি-জামায়াত ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুঃশাসনের কাল। একারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভার গৌরবান্বিত রাষ্ট্র, যার রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, যিনি একটানা সাড়ে ১৩ বছর ক্ষমতায় আসীন।
এই ইতিহাস সকলের জানা যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে খুন করার সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার সংগ্রামী জীবনে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে দুঃখের কষ্টিপাথরে সহিষ্ণুতার দীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন ২০০৭ সালে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে। পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই দীর্ঘ ২১ বছর পর সম্ভাবনার বাংলাদেশে তিনি হন প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অমানিশার দুর্যোগে প্রাণ বাঁচানোর দুঃসহ স্মৃতি; অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া জীবন নিয়ে আবার নির্যাতিত জনগণের জন্য রাতদিনের পরিশ্রম- কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর সময় হঠাৎ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি হলেন; শুরু হলো আরেক জীবন। সেই জীবনের স্মৃতি আছে তাঁর রচনায়, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে।
কারাগারে বন্দি শেখ হাসিনার অন্তর অপমান ও কষ্টে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিনি কখনো মনোবল হারাননি।২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তাঁকে বন্দি করে সংসদ ভবনের একটি বাড়িকে সাবজেলে পরিণত করা হয়। ওই সাবজেলের ভবনটি ছিল অত্যন্ত ময়লা ও নোংরা। পুরোনো গদি ছেঁড়া কাপড় চোপড়, পুরনো কাগজপত্র সব ছড়ানো। খাটখানা ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল না। খাবার আসতো কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। মাঝে মাঝে খাবার আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো। আর খাবারের মেনুও সস্তা জিনিসে ঠাসা ছিল। দুঃখের দিনে কষ্টের মাঝে পড়ে তিনি জাতির পিতার কথা স্মরণ করতেন। কারণ নিঃসঙ্গ কারাগারে তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিল স্মৃতি। অনেক কথাই তাঁর মনে পড়ত।
বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তাঁকে জেলখানায় সেলের ভেতরে রাখা হতো। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন আর দিবসরজনী কষ্ট সহ্য করে গেছেন। ১৯৭১ সালের বন্দি করে তাঁকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে নেয়া হয় যেখানে গ্রীষ্মকালে যেমন গরম, তেমন শীতের সময় শীত। রুটি ডাল ছাড়া কিছুই পেতেন না খেতে। অথচ ওই খাবার তিনি কখনোই পছন্দ করতেন না। তারপরেও তাঁর মুখ থেকে কোনও দিন কোনও কষ্টের কথা কেউ শোনেননি। নিজের কষ্টের কথা তিনি সব সময় চেপেই রাখতেন। শেখ হাসিনাও সেরকম একজন রাজনীতিবিদ যিনি অপরের দুঃখে সবসময় কাতর হন।
সাবজেলের ওই বাড়ির উত্তর দিকের জানালা দিয়ে গণভবন দেখা যেত। কষ্টের মধ্যেই কারাগারে জানালায় সকাল-বিকাল দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে গণভবন দেখতেন যেখানে তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল অবধি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবস্থান করেছিলেন। সবুজ মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় জনগণের চলাফেরা অবলোকন করতেন। ইচ্ছে হলেই বের হতে পারতেন না। কারণ তিনি তো বন্দি, দোতলায় একদম একা। বাইরে বের হওয়ার স্বাধীনতা নেই। কিন্তু তাঁর মনটা স্বাধীন ছিল, মনের কল্পনায়ই তিনি সবুজ মাঠ পেরিয়ে চলে যেতেন স্বপ্ন রাজ্যে। ওই বাড়িটার চারিদিকে অনেক গাছ ছিল। সেই প্রকৃতির প্রাণময়তা তাঁকে তৃপ্তি দিত। মানসিক চাপ আর দেশ ও জনতার চিন্তার মাঝে স্বস্তি খুঁজে নিতেন।
২০০৭ সালে সংসদ ভবনের অন্যান্য বাড়িতে স্পেশাল কোর্ট বসানো হয়েছিল। তারপর একটার পর একটা মামলা দিয়ে হয়রানি করতে থাকে শেখ হাসিনাকে। সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আবিষ্কার হলো সব চেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ তিনি। তাই প্রথমে দেশের বাইরে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্ত সফল হয়নি। পরে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে বিনা ওয়ারেন্টে টেনে হিঁচড়ে কোর্টে নিয়ে গিয়ে তারপর সাবজেলে ১১ মাস বন্দি করে রাখে। সম্পূর্ণ একাকী নিঃসঙ্গ বন্দিখানায় ছিলেন তিনি।
তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর বিচারের নামে প্রহসন চলে। তখন বিচারকরা তাদের বিবেক, চিন্তা, জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে বিচার করতে পারেন নি। উচ্চ আদালতে শপথ মোতাবেক বিচারকরা কাজও করেননি। বিচারকদের উপর গোয়েন্দাদের চাপ অব্যাহতভাবে ছিল। এজন্য তাঁকে জামিন দিতে নিষেধ করা হয়েছিল। উপরের নির্দেশে মামলার রায় হতো তখন। তিনি তখনকার ক্ষমতাবানদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যারা আজ ক্ষমতায় তাদেরও ভবিষ্যতে কারাগারে থাকতে হবে না এই গ্যারান্টি কি পেয়েছে? ক্ষমতার মসনদ ও কারাগার খুব কাছাকাছি।
সরকার প্রথমে চাঁদাবাজির মামলা দেয় তিন কোটি টাকার। যারা চাপে পড়ে মামলা করেছিল তারা ভাল করেই জানত তাদের কাছে শেখ হাসিনা কোনদিন চাঁদা চাননি। ওদের তিনি চেনেনও না। তিনি তাঁর জীবনে কোনদিন কারও কাছে কোন টাকা চাননি। অথচ মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করার জন্যই যাকে খুশি তাকে দিয়েই যা খুশি তা বলানো হতো। একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল সেসময়ের প্রশাসন। কারণ তারা জানত, নির্বাচন হলে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে। তারা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। শেখ হাসিনার এসব ভাবনা বাস্তব হয়ে উঠেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভের মধ্য দিয়ে।
শেখ হাসিনা সাবেক-প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসকদের দ্বারা মিথ্যা মামলায় হয়রানি ও কারা-যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন দুর্ভাগ্যবশত। কারণ স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মতো নিপীড়ক শাসক থাকার কথা ছিল না, দেশও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছিল। অথচ দেশ-বিদেশে টিকে থাকা বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা তখনও সক্রিয়। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের একাধিকবার চেষ্টা চলেছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে’র পর থেকেই যা ২০২০ পর্যন্ত ২১ বার হিসাবে তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দেয়। আগেই বলেছি, সাবজেলে থাকার সময় স্লো পয়জনিংয়ে তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির। অথচ ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাকালে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের হলেও কখনো চাঁদাবাজির মামলা করা হয়নি। এজন্য শেখ হাসিনার মনে হয়েছে, মামলাবাজ জোট সরকার থেকেও বড় আবিষ্কারক ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার জন্য তিনি আন্দোলন করেছিলেন। আটষট্টি জন মানুষ জীবন দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনীর হাতে। সেই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যে নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। চারদলীয় জোটের ভোট কারচুপির নীলনকশা প্রতিহত করার জন্যই আন্দোলন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করে গণতন্ত্রকে সুসংহত করাও তাঁর মূল টার্গেট ছিল। নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর ভাষায়- ‘আন্দোলন করে দাবি পূরণ করলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করলাম। যেই দ্রুত নির্বাচনের কথা বললাম, সেই আমি চাঁদাবাজ হয়ে গেলাম, দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম। আমার স্থান হল কারাগারে। পাঁচটি বছর চারদলীয় জোট তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আমার ও আমার পরিবারের দুর্নীতির কোন কিছু পায় কিনা, পায় নাই। পেয়েছে ফখরুদ্দীন সরকার।’
দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ শেখ হাসিনা জেলে থাকার কারণে তাঁর সন্তান পুতুল-জয়ের পাশে সব সময় থাকতে পারেননি। এই বেদনা তিনি তুলে ধরেছেন নিজের লেখায়। রাজনীতির জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা বঙ্গবন্ধুর লেখনিতেও আছে। অনুরূপভাবে একজন বন্দি মা কতোটা অসহায়, তার বর্ণনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। তার একমাত্র কন্যা পুতুল মা হবেন; থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মা হিসেবে মেয়ের কাছে থাকাটা খুব দরকার। যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেও যেতে দেয়া হয়নি। সেই সময়ের প্রশাসন আটকে দিয়েছিল তাঁর বিদেশ ভ্রমণ।
‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে এভাবেই তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন কারান্তরালে যাপিত জীবন-যাপন করার মুহূর্তে। তিনি ওই গ্রন্থে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ করেছেন। সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চাপে চাঁদাবাজির মামলাগুলো কীভাবে করা হয়েছিল তাও তিনি জানতেন। গণতন্ত্রকে সুসংহত করা এবং জনগণের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টাকে চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল যারা, তারা গোপনে ষড়যন্ত্র করে মানুষকে সামরিক শাসন উপহার দিতে চেয়েছিল। ২০০৭ সালে প্রথমে সশস্ত্রবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়। নির্বাচনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করে দুই বছর পর নির্বাচন হবে। সাধারণ মানুষ নির্বাচন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। অথচ তখন নতুন নতুন দল গঠন করা হচ্ছে। ‘মাইনাস টু’ অনুসারে তৃতীয় শক্তির উত্থান প্রত্যাশা করছে শাসকগোষ্ঠী। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সুদখোর, কালোটাকার মালিকরা টাকা সাদা করে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছে। অন্যদিকে ‘দুদক’কে দিয়ে রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছে বিতর্কিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার, একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে সিনিয়র রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নয়টি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছয়টি মোট ১৫টি মামলা করা হয়। একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে এবং তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে ‘দুদক’কে ব্যবহার করে। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাইকোকে অবৈধভাবে গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ এনে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করে ‘দুদক’। ২০০৮ সালের ৫ মে এ মামলায় নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলার দায় থেকে অব্যাহতির জন্য শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে হাইকোর্টে বাতিল আবেদন করলে ৭ জুলাই হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন। এই রুলের ওপর শুনানি শেষে আদালত মামলাটি বাতিল ঘোষণা করেন। এভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলার পরিসমাপ্তি ঘটে। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উদঘাটিত হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলাগুলো করা হয়েছিল। এজন্য হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিধিমালার অসংগতি দূর করতে তা সংশোধনেরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হওয়ার সময় শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশে দিক-নির্দেশনামূলক একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে অভিব্যক্ত শেখ হাসিনার সাহসী ও প্রজ্ঞামণ্ডিত উচ্চারণগুলো তখনকার নেতাকর্মীরা অনুসরণ করেছিলেন। কারণ গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সারাজীবন সংগ্রাম করা একজন কর্মঠ নেতার জন্যই অন্যেরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল। আর জনগণের দাবির কারণেই ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্ত হন।
১১ জুনের প্রভাবে ও তাঁর সৎ নেতৃত্বের কারণেই নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অতীতের জেল-জুলুম, হত্যার প্রচেষ্টা এবং হুমকি আর বর্তমানের অপপ্রচারের মধ্যেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে ২০৪১ সালেই বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে- এটা নিশ্চিত। ২০২২ সালে তাঁর কারামুক্তি দিবস উন্নয়ন-বিপ্লবের বিস্ময়কর জয়যাত্রায় পরিপূর্ণ।
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়