স্টাফ রিপোর্টার \ টাঙ্গাইলে সৃষ্টি কোচিংয়ের আবাসিক ভবনে গত সোমবার বিকালে ৫ম শ্রেণীর ছাত্র শিহাবের (১২) রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। আবাসিক ভবনের বাথরুমে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে দ্রুত হাসপাতালে নেয় কর্তৃপক্ষ । হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। শিহাবের স্বজনদের দাবী তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে সৃষ্টি শিক্ষা পরিবারের চেয়ারম্যান ড. শরিফুল ইসলাম রিপন এ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
বিষয়টি টাঙ্গাইল সদর থানাকে অবহিত করলে থানা থেকে পুলিশ এসে লাশ ময়নাতদন্তে পাঠায়। এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মুহাম্মদ সরোয়ার হোসেন জানান, এটি একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
নিহত শিহাব টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার বেরবাড়ি এলাকার সিঙ্গাপুর প্রবাসী ইলিয়াস হোসেনের ছেলে। তার পরিবারের দাবী এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
শিহাবের ফুপাতো ভাই আল আমিন সিকদার জানান, গত জানুয়ারিতে শিহাবকে সৃষ্টি কোচিংয়ের আবাসিকে ভর্তি করা হয়। নিয়মিত ভালোভাবেই পড়াশোনা করছিলো শিহাব। সোমবার বিকালে হঠাৎ সৃষ্টি কোচিং থেকে ফোন দিয়ে বলা হয় শিহাব অসুস্থ আপনারা তাড়াতাড়ি আসেন। পরবর্তীতে ওই নাম্বারে ফোন দিয়ে শিহাবের অসুস্থতার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কোচিং কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয় সিএনজি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে, এরপর আবার বলা হয় সে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। পরিবারের লোকজন তাড়াহুড়ো করে সৃষ্টি ভবনের কাছে গেলে সেখানে তাদের ঢুকতে না দিয়ে হাসপাতালে যেতে বলা হয়। এসব অসঙ্গতির থেকেই পরিবার নিশ্চিত হয়েছে, শিহাবকে শারিরীক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
আল আমিন আরও জানান, হাসপাতালে আসার পর জানতে পারি শিহাব মারা গেছে, সৃষ্টি কোচিংয়ের শিক্ষকরা তাকে জানান, আবাসিকের বাথরুমে ঝুলন্ত অবস্থায় শিহাবকে দেখার পর সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
নিহত শিহাবের দাদা ইসমাইল হোসেন বলেন, বাড়ি থেকে যোগাযোগের জন্য ফোন করা হলে সব সময় শিহাবকে পাওয়া যেতো না। সৃষ্টি কর্তৃপক্ষ শিহাবের হাতে ফোন দিতো না। বিষয়টি খুব রহস্যজনক।
নিহত শিহাবের পিতা ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমি সন্তান হত্যার বিচার চাই। অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার কাকুতি মিনতি জানান তিনি। তিনি প্রতিটি মা বাবা কে উদ্যেশ্য করে বলেন, আপনারা কেউ নামি দামি স্কুল/কোচিং শুনে আপনার সন্তান কে স্কুলে ভর্তি করবেন না। এসময় তিনি বলেন আমার সন্তানের জন্য আমি টাকা দিয়ে আজরাইল কিনেছিলাম।
সৃষ্টি একাডেমিক স্কুলের উপাধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন জানান, শিহাব গলায় গামছা পেঁচিয়ে বাথরুমের ঝরনায় ঝুলে আত্মহত্যা করেছে । ভবনে দায়িত্বরত শিক্ষকরাই বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে দেখতে পেয়ে দ্রুত টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে সৃষ্টি শিক্ষা পরিবারের চেয়ারম্যান ড. শরিফুল ইসলাম রিপনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি পথে প্রান্তর‘কে জানান, শিক্ষার্থী নিহতের বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন ইতি মধ্যে শিক্ষকদের মধ্য থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ র্যাব সহ অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা তাদের তদন্ত করছে আমরা তাদের সব দিক থেকে সহায়তা করছি। এ বিষয়ে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন “প্রতিষ্ঠান সবার আগে” কোন ব্যাক্তি অপরাধী হলে সেই দায় প্রতিষ্ঠানের না।, ইতিপূর্বে আবাসিক ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে সিসি ক্যামেরা থাকলেও বর্তমানে শুধু ভবনের প্রবেশ পথে সিসি ক্যামেরা চলমান রয়েছে, যেখানে শুধু ভবনে গমনাগমনের চিত্র ধারণ করা হয়। সঠিক ব্যবস্থাপনার কারনে সিসি ক্যামেরাগুলো সচল রাখা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে স্কুল ছাত্র শিহাব নিহতের ঘটনায় টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবের সামনে মানব বন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এসময় শিহাবের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিল। সমাবেশ শুরু হলে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ এতে যোগ দেয়। সকাল থেকে বিভিন্ন স্কুল কলেজের বিপুল সংক্ষ্যক শিক্ষার্থী প্রেস ক্লাবের সামনে এসে জড়ো হতে থাকে। তারা শিহাব নিহতের ঘটনায় দোষীদের গ্রেফতারের দাবী জানান। তাদের অভিযোগ এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড । একটি বার বছরের শিশু কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। ঠিক কি কারনে শিহাব কে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক তদন্তের দাবী জানান তারা। এ সময় শিক্ষার্থীরা ৫ দফা দাবি পেশ করে। দাবিগুলো হলো: ১. আবাসিকের ৪র্থ তলার দায়িত্বরত শিক্ষককে অনতিবিলম্বে রিমান্ডে নিতে হবে, ২. প্রকৃত ঘটনা উৎঘাটন করে দোষীকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে, ৩. আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের কোন মানসিক নির্যাতন করা যাবে না, ৪. আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য অভিযোগ বাক্সের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের অসুবিধার কথা জানাতে পারে, ৫. আগামি রবিবারের মধ্যে যদি দোষীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
এ সময় শিক্ষকদের একটি অংশকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করতে ছবি তুলতেও দেখা যায়। কেন ছবি তুলছেন শিক্ষকরা, জানতে চাইলে তারা এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
মানব বন্ধন থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী জানান, সৃষ্টি একাডেমিক স্কুলের শিক্ষকরা প্রায়ই আবাসিক শিক্ষার্থী দের সঙ্গে খারাপ আচরন করেন। সেখানে প্রায়শই শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কর্তৃপক্ষের কাছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়না। এর সব কিছুই পেছন থেকে মদদ দেন সৃষ্টি একাডেমিক স্কুলের উপাধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও কোন প্রতিকার পায়নি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার পরিবার।ওই শিক্ষার্থী জানান স্কুল কমিটি টাকার বিনিময়ে এসকল অন্যায় থেকে বার বার রেহাই পান।
অপরদিকে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সৃষ্টির ছাত্র শিহাবের উপর পাশবিক নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে মানব বন্ধন করেছে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগ। উপস্থিত ছাত্রলীগের নেতারা অভিযোগ করেন, সৃষ্টি কোচিং এর জন্ম থেকে এরকম আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনাগুলোও তারা নানা ভাবে ধামাচাপা দিয়েছে। একের পর এক ঘটনা ঘটিয়েও তারা কিভাবে পার পাচ্ছে এটাই এখন বড় প্রশ্ন । ইতিপূর্বে স্কুলটির বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছিল। সৃষ্টির একাংশ জঙ্গি অর্থায়ন ও মদদের সাথে জড়িত বলে মন্তব্য করেন নেতারা।
স্কুল পড়ুয়া ৫ম শ্রেনীর শিক্ষার্থী শিহাবের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।