স্টাফ রিপোর্টার \ ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর দুই সিটিতে বসেছে মোট ১৭টি পশুর হাট। এর বাইরে গাবতলীর স্থায়ী পশুর হাট ও ডেমরার সারুলিয়ার পশুহাট। কোরবানির ঈদকে ঘিরে পশুর হাটগুলোতে হাজার হাজার মানুষের সমাগমে লেনদেন হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। বিগত বছরের মতো এবারও পশুর হাটগুলোতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হাটের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এবার সমন্বিতভাবে কাজ করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ডিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
হাটে যেকোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে হাট ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইজারাদারদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ডিএমপি। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ডিএমপির অপরাধ এবং গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করার পর এ নিরাপত্তা পরিকল্পনা ঢেলে সাজানো হয়েছে।
ইজারাদারদের ডিএমপি অনুরোধ জানিয়েছে, যাতে করে হাটের আশপাশে কোনো ধরনের ভ্রাম্যমাণ দোকান না থাকে। কারণ ভ্রাম্যমাণ দোকানে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেশি থাকে। এসব দোকান থেকে ব্যবসায়ীরা চা, পান, বিড়ি, শরবত ও ঝালমুড়ি খেলে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়তে পারেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা জরুরি।
ডিএমপির নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রত্যেকটি হাটে পুলিশের কন্ট্রোল রুম এবং সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। জাল টাকা শনাক্তে স্থাপিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসানো হয়েছে ইলেকট্রিক মেশিন ও প্রজেক্টর। প্রজেক্টরে জাল টাকা ও অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা রোধে পুলিশের নির্মিত সচেতনতামূলক প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ হাট ও জনসমাগম এবং লেনদেন বিবেচনায় প্রায় প্রতিটি হাটে শতাধিকের বেশি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। হাট ও হাটের আশপাশে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মোতায়েন রয়েছেন সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা। ১০০ ফুট অন্তর বসানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। দূরবীণ হাতে হাটের সার্বক্ষণিক চিত্র পর্যবেক্ষণ করছেন পুলিশ সদস্যরা। প্রতিবারের মতো এবারও রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে কোনো হকার বসতে না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএমপি।
সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নির্বিঘ্নে হাট পরিচালনার জন্য ইজারাদারদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি। নির্দেশনাগুলো হচ্ছে— জোর করে কোরবানির পশু হাটে না নামানো, নির্ধারিত সময়ের আগে কোরবানির পশুর হাটে ঢুকতে না দেওয়া, সিটি করর্পোরেশন ঘোষণা করা নির্ধারিত হারের বেশি হাসিল না রাখা ও হাটের আশেপাশে ভ্রাম্যমাণ দোকান না রাখা। সিটি করর্পোরেশন এবং জেলা প্রশাসকের নির্ধারিত চৌহদ্দির বাইরে পশুর হাট না বসানো, নাইটমোডে ছবি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি স্থাপন, জালনোট শনাক্তে বুথ স্থাপন, নির্ধারিত হাসিলের তালিকা বড় করে ব্যানারে প্রকাশ্য স্থানে লাগানো, হাটে জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা ও পর্যাপ্তসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা।
অন্যদিকে পশুর হাটকেন্দ্রিক নিরাপত্তার পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশ ও বাহিরপথে নিরাপত্তা জোরদারের পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএমপি।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গত রোজার ঈদে আমাদের প্রস্তুতি ছিল বলে রাজধানীতে বড় কোনো অপরাধ ঘটেনি। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করেও আমাদের সবধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। গতবার দেখা গিয়েছিল পূজার আগে ও কোরবানির সময় জাল টাকার কারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং হাটবাজারে ছড়ানোর চেষ্টা করে। তাদের গ্রেফতার করে দেখা গেছে, যারা এ জাল টাকার ব্যবসা করে তারা কিছুদিন সাজা ভোগ করে কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার একই অপরাধে যুক্ত হয়। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এখন পর্যন্ত জাল টাকা কারবারের কোনো সন্ধান আমরা পাইনি। তবে, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার প্রস্তাব দিয়েছেন, ঈদের আগে কেউ যদি বড় ধরনের লেনদেন করতে চান তাহলে তিনি পুলিশের সহযোগিতা নেবেন।
মলম ও অজ্ঞান পার্টির বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় ব্যবসীয়দের কিছু খাইয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে সর্বস্বান্ত করে দেয় অজ্ঞান পার্টির লোকেরা। রাজধানীতে পশুহাটের যারা ইজারা নিয়েছেন তাদের বলা হয়েছে, স্থায়ী হোটেল ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী ভাসমান দোকান থেকে কিছু খাবেন না। এতে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়বেন না ব্যবসায়ীরা।
ডিবিপ্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার আরও বলেন, রাজধানীতে প্রবেশের সময় এক হাটের ট্রাক আরেক হাটে জোর করে না রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিটি ট্রাকের সামনে সংশ্লিষ্ট হাটের ব্যানার লাগানোর জন্য বলা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় সবগুলো হাটে কোরবানির পশু চলে এসেছে; তবে বেচাকেনা এখনো শুরু হয়নি। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চল থেকে দ্রুত ঢাকায় ঢুকছে কোরবানির পশু। পশুবাহী ট্রাক কেউ যাতে ডাকাতি করতে না পারে সেজন্য ডিবি কাজ করছে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে ৫০টি থানা এলাকায় ঢাকা মেট্রোপলিটনের আওতায় যতগুলো গরুর হাট বসেছে সবগুলো হাটে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। এছাড়া ডিএমপির তথ্য সংগ্রহ বিভাগ, গোয়েন্দা বিভাগ ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য পশুহাটের নিরাপত্তা, জাল টাকা প্রতিরোধ ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যসহ সব ধরনের অপরাধ নির্মূলে কাজ করবে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পুলিশের পাশাপাশি র্যাবও হাটকেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। পশুর হাটে নগদ টাকার লেনদেন হয়। সেখানে বিভিন্ন ব্যাংকের অস্থায়ী বুথের নিরাপত্তায় সহযোগিতা করবে র্যাব। অনেকে এক হাটের গরুর ট্রাক অন্য হাটে নিতে বাধ্য করেন, অজ্ঞান ও মলমপার্টির সদস্যরা সক্রিয় হয়, হাটকে কেন্দ্র করে এ ধরনের কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার ও অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এন্ট্রি পয়েন্ট, রেলপথ, নৌপথ ও সড়কপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠে রয়েছেন র্যাব সদস্যরা।
তিনি আরও বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশে পশুর হাটের নিরাপত্তায় র্যাবের নিরাপত্তা প্ল্যান সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে র্যাব স্মার্ট পেট্রোলিং টিমের কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে, অস্থায়ী ক্যাম্প ও চেক পোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। মহাসড়কে পশুবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি ও ডাকাতিরোধে এবং গরুর হাটে চাঁদাবাজি, ছিনতাইকারী ও অজ্ঞান পার্টি প্রতিরোধে সাদা পোশাকে র্যাবের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যদের মতো র্যাবও ছুটি উৎসর্গ করে নিরাপত্তা বিধান করে থাকে।