স্টাফ রিপোর্টার- রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিতে যুক্তরাজ্যে গিয়ে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে নিয়ে স্মৃতিচারণের পাশাপাশি বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন ও গুমের অভিযোগ নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিনি যুক্তরাজ্যের রানি ছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তিনি কমনওয়েলথেরও নেতা ছিলেন। তাই কমনওয়েলথের সদস্য দেশ হিসেবে তিনি আমাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘শুধু তাই নয়, তিনি ৭০ বছর ধরে সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। তিনি শুধু রানিই ছিলেন না, একজন মমতাময়ী, মাতৃসুলভ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যখনই আমার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, আমি সেটা অনুভব করেছি।’
বিবিসি: তাঁকে ঘিরে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো কী?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা: ১৯৬১ সালে যখন তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন, আমার তখন তাকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমরা তখন ছোট ছিলাম। আমরা আমার বাবার অফিসে ছিলাম। কারণ আমরা জানতাম যে তিনি ওই রাস্তা দিয়ে যাবেন। আমাদের পুরো পরিবার জানালায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম, হাতে বাইনোকুলার নিয়ে যেন আমরা তাকে ভালোভাবে দেখতে পারি। আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার সঙ্গে প্রতি সফরেই আমার দেখা হয়েছে। আমি ৭টি কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। প্রতিবারই তার সঙ্গে সাক্ষাতের ও কথা বলার সুযোগ হয়েছে এবং অলিম্পিক গেমসের সময়ও তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি এসেছিলাম। সেটিও খুব ভালো সুযোগ ছিল, আমরা দীর্ঘসময় আলোচনা করেছিলাম।
বিবিসি: কয়েক দশকে তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে আপনার। যখন ছোট ছিলেন তখন আপনার বাবার অফিসে, এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং পরে অনেকগুলো কমনওয়েলথ সম্মেলনে। তিনি কয়েক দশক ধরে আপনার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন।
শেখ হাসিনা: তার স্মৃতিশক্তি ছিল চমৎকার। কমনওয়েলথ সম্মেলনে তিনি যখন আমাকে দেখতে পেতেন না, তখন খোঁজ নিতেন, ‘হাসিনা কোথায়? আমি তো তাকে দেখতে পাচ্ছি না।’
বিবিসি: কমনওয়েলথ আপনার কাছে ও বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
শেখ হাসিনা: আমরা একসঙ্গে থাকলে অনেক সুযোগ তৈরি হয়। সুতরাং এটি গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়ের জন্য, নতুন আইডিয়া পাওয়ার জন্য বা দেশ ও মানুষের জন্য ভালো কিছু করার সুযোগ তৈরি হয় কমনওয়েলথে। সুতরাং আমি মনে করি যে এটি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে একটি দেশ একা এগিয়ে যেতে পারে না। পৃথিবীতে সবাই পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং এরকম পরিস্থিতিতে সদস্য দেশগুলোর জন্য কমনওয়েলথের গুরুত্ব অনেক। আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তাহলে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করতে পারব। কারণ এখানে উন্নত, উন্নয়নশীল, দরিদ্র বা ছোট দ্বীপ দেশ-সবই আছে।
বিবিসি: আপনার দেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক আছে। অনেক বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে আসেন এবং এখানে জীবনযাপন করেন। আপনার দেশে নিযুক্ত প্রয়াত রানির হাইকমিশনার আপনার সরকারের কাছে আগামী বছরে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার চেয়েছেন। আপনি কি এই অঙ্গীকার করবেন?
শেখ হাসিনা: দেখুন, আমাদের দেশ দীর্ঘ সময় সামরিক শাসকের অধীনে ছিল। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেই হোক আর প্রকাশ্যে বা গোপনেই হোক। ১৯৭৫ সালে যখন আমার বাবাকে হত্যা করা হয়, তিনি তখন দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আপনি জানেন, আমার পুরো পরিবারের আমার মা, ভাইয়েরা, তাদের স্ত্রীরা এবং অন্যান্য সদস্যসহ ১৮ জনকে হত্যা করা হয়।
তখন থেকে পরের ২১ বছর পর্যন্ত কোনো না কোনো সময় আমাদের দেশে সামরিক শাসন ছিল। বারবার। আনুমানিক ২০ বার সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল, প্রতিবারই রক্তক্ষয় হয়েছে। কোনো গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। আমার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আমার সংগ্রাম করতে হয়েছে।
বিবিসি: কিন্তু জাতিসংঘ ও রানির হাইকমিশনার আপনার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করতে এবং গুমের অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘ কথা বলেছে।
শেখ হাসিনা: অনেক মানুষই অভিযোগ তুলতে পারে। কিন্তু তার কতটুকু সত্য, তা আপনাকে বিচার করতে হবে। তার আগে কোনো মন্তব্য করা উচিত না। কারণ আমি আপনাকে বলেছি, আমাদের দেশে সেনা শাসক দেশ শাসন করেছে। তারা রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। তারা কখনো মানুষের কাছে গিয়ে তাদের জন্য ভোট চায়নি। তারা সেনাবাহিনী, প্রশাসন ব্যবহার করেছে শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সময় আপনি নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে পাবেন।
বিবিসি: আমি পরিষ্কারভাবে শুনেছি যে আপনি সেসব নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে অঙ্গীকার করেছেন।
শেখ হাসিনা: অবশ্যই। এটা আমার সংগ্রাম। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা আমার সংগ্রাম।
বিবিসি: গুমের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, আপনি কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন? এই বিষয়ে জাতিসংঘ উদ্বেগ জানিয়েছে।
শেখ হাসিনা: আপনার দেশে বা কত দেশে কত মানুষ হারিয়ে যায় তা আপনি বিচার করতে পারবেন। এই বিষয়ে আমি মনে করি প্রথমে সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তারপর তারা অভিযোগ করতে পারে।
বিবিসি: শেষ প্রশ্ন আগামীকালের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান একটি বৈশ্বিক ইভেন্ট। আগামীকাল যখন আপনি এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাবেন, তখন আপনার কী চিন্তা থাকবে বলে মনে করেন।
শেখ হাসিনা: আমরা রানিকে ভালোবাসি। তিনি অত্যন্ত মমতাময়ী ছিলেন। শুধু তাই নয়, আমি ভাগ্যবান যে তিনি সবসময় আমার নামও মনে রাখতেন। আমি এখানে এসেছি তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। ধন্যবাদ