স্টাফ রিপোর্টার – যারা আমাকে নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট চর্চায় তাদের বিপক্ষে আবিষ্কার করেছেন, আমার বিরুদ্ধে নানা সময়ে অভিযোগ তুলেছেন তাদের নিয়ে আজ কোনো অভিযোগ নাই, অনুযোগও নাই। তারাও ভালো থাকবেন, সে প্রত্যাশা করবো। বলেছেন পুলিশের বিদায়ী মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। বৃহস্পতিবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি বেনজীর আহমেদ এসব কথা বলেন।
আইজিপি বলেন, খুন হলেও দুটো পক্ষ হয়ে যায়। ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্ত। পুলিশ দুই দলকে খুশি করতে পারে না। এ কারণে একপক্ষ সব সময় ভুল বোঝে। আইনি দায়িত্ব পালন করতে যাওয়ায় অনেকেই বিপক্ষে গেছেন। সেটা বিদায়লগ্নে আর বলতে চাই না।
সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জানিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, জিম্মিদশা থেকে ওই এলাকার মানুষকে মুক্ত করতে পেরেছি।
পুলিশের সবচেয়ে বড় পদে দায়িত্ব পালনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোনো মানুষই আমাদের প্রতিপক্ষ নয়। রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এর বাইরে আরেকটা বিষয় থাকে সামাজিক প্রত্যাশা। সামাজিক প্রত্যাশার জন্যও অনেক কিছু করতে হয়েছে। দায়িত্ব পালনে যিনি অপর পাড়ে ছিলেন। লাইনের উল্টো দিকে ছিলেন। তিনি নিজেকে প্রতিপক্ষ মনে করলে সঠিক হবে না।
বেনজীর আহমেদ আরও বলেন, সরকারি দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। ভালো কাজের ক্রেডিট সরকারের এবং মানুষের। কোনো ব্যর্থতা থাকলে আমার।
কাউন্সিলর একরামুল হকের নিহতের ঘটনা নিয়ে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, কাউন্সিলর একরামুল হকের ঘটনা আমার ব্যক্তিগত ক্যাপাসিটিতে ঘটেনি। যে ঘটনাটির কথা উল্লেখ করলেন এটা কিন্তু একটা লিগ্যাল বিষয়। লিগ্যাল বিষয়টা যদি অন্যায্য বা অনৈতিক এ ধরনের কিছু চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। এটা আমার ব্যক্তিগত ক্যাপাসিটিতে ঘটেনি। এটা ঘটেছে সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে…। আমার ফিল্ড লেভেলের লোকজন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটনা ঘটার পরে যে ভদ্রলোক নিহত হয়েছেন তার সঙ্গে কিন্তু ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। এটা কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয় না।
আইজিপি বলেন, খুন হলেও দুটো পক্ষ হয়ে যায়। ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্ত। পুলিশ দুই দলকে খুশি করতে পারে না। এ কারণে একপক্ষ সব সময় ভুল বোঝে। আইনি দায়িত্ব পালন করতে যাওয়ায় অনেকেই বিপক্ষে গেছেন। সেটা বিদায়লগ্নে আর বলতে চাই না।
পুলিশের বিদায়ী মহাপরিদর্শক বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে এ দেশের মানুষকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। তাই আমি মনে করি আমাদের দেশে যে আইন আছে সেটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মনে হয় নেই।
ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, সরকারি দায়িত্ব প্রতিপালন করার জন্য। আমাদের মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গত ১২ বছরে আমি পুলিশ কমিশনার ছিলাম, ডিজি র্যাব ছিলাম ও আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষ করছি। এ তিন ক্যাটাগরিতে যা কিছু অর্জন হয়েছে তার পুরো কৃতিত্ব বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের। আর কোনো ব্যর্থতা থাকলে সেটা অবশ্যই আমার। এটা কাঁধে নেয়ার সাহস আমার রয়েছে।
মানবাধিকার উন্নয়নের জন্য কী করেছেন- সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানবাধিকার নিয়ে আমাদের সংবিধান যখন রচিত হয়েছে তখন পৃথিবীর ভালো ভালো সংবিধান রচিত হওয়ার কাজ শেষ। বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে সংবিধানে এত কিছু আছে তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, বাংলাদেশের সব আইনের উৎস সংবিধান। এ দেশে কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সেটা বাতিল করার ক্ষমতা রাখেন উচ্চ আদালত। এমন অনেক আইন বাতিলও করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে এদেশের মানুষকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আমাদের দেশে যে আইন আছে সেটা পৃথিবীর অন্য দেশে মনে হয় নেই।
তিনি আরও বলেন, পুলিশের কাছে যে অস্ত্র দেয়া হয়, সেটা আত্মরক্ষার জন্য। পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ অস্ত্র শুধু জীবন রক্ষার জন্য ব্যবহার করতে পারবে। যেখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণহানি ঘটেছে, সেগুলো সঠিক না বেঠিক তা অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে।
ডিএমপিতে পেশা জীবনের দীর্ঘ সময়ের স্মৃতিচারণা করে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের সঙ্গে আমার একধরনের পেশাগত ও আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯০ সালে সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগদান করে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এখানে কর্মরত ছিলাম। আবার ২০০০ সালে উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগদান করি। সর্বশেষ ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে ডিএমপি কমিশনার হিসেবে যোগদান করি। আমার পেশা জীবনের ১০ বছর অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত ছিলাম।
ড. বেনজীর আহমেদকে অবসরজনিত বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। বাংলাদেশ পুলিশ অডিটরিয়াম, রাজারবাগে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এ বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হয়।
এ সময় বেনজীর আহমেদ বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কমিশনার হিসেবে যোগদান করি তখন ডিএমপিতে গাড়ি চুরি, ছিনতাই, মাদকের মতো নানাবিধ সমস্যা ছিল। প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেই সময়ে যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করেছেন তাদের প্রত্যেকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাদের অবদান আমি স্মরণ করি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে অবসরে যাচ্ছেন। অবসর প্রস্তুতিজনিত ছুটিকালীন তার নিরাপত্তার জন্য বিশেষ পুলিশ মোতায়েন করা হবে। বুধবার সিনিয়র সহকারী সচিব শফিকুল ইসলামের সই করা এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ড. বেনজীর আহমেদের অবসর প্রস্তুতিজনিত ছুটিকালীন তার নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে গাড়িসহ ১/৬ ফর্মেশনে সাদা পোশাকে এসকর্ট, অস্ত্রসহ ইউনিফর্মধারী দুজন সার্বক্ষণিক দেহরক্ষী এবং ১/৩ ফর্মেশনে হাউসগার্ড সার্বক্ষণিকভাবে মোতায়েনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের অবসরের বিষয়টি জানানো হয়। ড. বেনজীর ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল আইজিপি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ শাখা থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হওয়ায় সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ অনুযায়ী, সরকারি চাকরি থেকে তাকে অবসর প্রদান করা হলো। একই প্রজ্ঞাপনে এক বছরের জন্য তার অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) মঞ্জুর করা হয়। ড. বেনজীর ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল আইজিপি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
সপ্তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ ১৯৮৮ সালে পুলিশে সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনারসহ বিভিন্ন জেলায় এসপির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বেও ছিলেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
ড. বেনজীর উপমহাদেশের প্রথম পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ডিপার্টমেন্ট অব পিস কিপিং অপারেশনসের অধীনে মিশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি কসোভো শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের কন্টিনজেন্ট কমান্ডারের দায়িত্বও পালন করেন।