স্টাফ রিপোর্টার – পূর্বাঞ্চলের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের নিচে নেমে যায় এবং আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সির কারণেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আনস্টেবল হয়েই পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ট্রিপ করে। এতে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুৎ বিপর্যয় নিয়ে এমন কথা বলেছেন। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে গত ৪ অক্টোবরের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের বিষয়ে করা এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি বলেন, এ ধরনের বিভ্রাট এড়াতে হলে অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সঞ্চালন ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে আছে। আরও আধুনিক ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, গত ৪ অক্টোবর দুপুর ২টার দিকে পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘাটতি ছিল এবং পশ্চিমাঞ্চলে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল। এ অবস্থায় পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। ঘটনার সময় আশুগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জের ২৩০ কেভির দুটি সার্কিট এবং ঘোড়াশালের দুটি সার্কিট ট্রিপ করায় পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পূর্বাঞ্চলের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের নিচে নেমে যায় এবং আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সির কারণেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আনস্টেবল হয়েই পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ট্রিপ করে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়। এ সময় বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান, পিডিবির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ে গ্রিড সিস্টেম এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কোনো অবকাঠামোগত ক্ষতি (ফিজিক্যাল ড্যামেজ) হয়নি বলেও জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী। গত মঙ্গলবার জাতীয় গ্রিডের সঞ্চালন লাইন বিভ্রাটের পর ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। সেদিন দুপুর ২টার দিকে এ বিপর্যয় ঘটে। এরপর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট অঞ্চল বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
নসরুল হামিদ বলেন, গ্রিড বিপর্যয় হলেও গ্রিড সিস্টেম এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কোনো ফিজিক্যাল ড্যামেজ পরিলক্ষিত হয়নি। সেজন্য কমিটির গ্রিড সিস্টেমের বিভিন্ন প্রটেকশন ডাটা, ট্রিপিং রেকর্ড, বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালনার ডাটা পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে কিছু সময় প্রয়োজন হচ্ছে। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সেগুলোর আরও দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে ব্যাপারেও পরিকল্পনা চলছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, গত ৪ অক্টোবর দুপুর ১টায় ১১ হাজার ১৯৮ মেগাওয়াট এবং দুপুর ২টায় ১১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে যথাক্রমে ১০ হাজার ১৯২ মেগাওয়াট এবং ১০ হাজার ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু দুপুর ২টায় জাতীয় গ্রিডে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় গ্রিডে পূর্বাঞ্চলের পুরো অংশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট শুরু হয়। ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও সিলেট জোন একযোগে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।
ঘটনার পরপরই বিদ্যুৎ সংযোগ পুনর্বহাল কার্যক্রম শুরু হয় জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘটনার ৩২ মিনিটের মধ্যে ২টা ৩৬ মিনিটে সিরাজগঞ্জের আশুগঞ্জে ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন এবং ২টা ৪৩ মিনিটে ঘোড়াশাল জিআইএস থেকে ঘোড়াশাল এআইএস ২৩০ কেভি লাইন চালু করা হয়। তিনি বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে গণভবন ও ৫টা ৪০ মিনিটে বঙ্গভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা হয়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে পিজিসিবি (পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ)।
তিনি আরও বলেন, রাত ৯টার মধ্যে সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক করা হয়। রাত ৯টায় চাহিদার বিপরীতে সারাদেশে ৮ হাজার ৪৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ রেকর্ড করা হয়, যা রাত ১২টায় বেড়ে প্রায় ১০ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। প্রকৌশলীদের কর্মতৎপরায় ৭ ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ রেস্টরেশন (সংযোগ পুনর্বহাল) কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ উদ্ঘাটনে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে জানিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, কমিটির সদস্যরা ৫ অক্টোবর ঘোড়াশাল ও আশুগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট গ্রিড উপকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। ঘটনার প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ওই সময় পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় এবং পশ্চিমাঞ্চলে বাড়তি উৎপাদন থাকায় পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে ১১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হচ্ছিল।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার সময় আশুগঞ্জে ২৩০ কেভির দুটি সার্কিট এবং ঘোড়াশালের এআইএস থেকে ঘোড়াশাল জিআইএস ২৩০ কেভির সার্কিট ট্রিপ করায় পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ভারসম্যহীনতা তৈরি হয়। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের নিচে নেমে যায়। আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সিজনিত কারণে গ্রিড আনস্টেবল হয়ে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ট্রিপ করে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়।
এর আগে ২০১৪ ও ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে। তখন তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সেই তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর কত শতাংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, জানতে চাইলে নসরুল হামিদ বলেন, অনেক সময় অনেকগুলো ঘটনা মানুষের ঘটানো থাকে, আবার মানুষের ঘটনো থাকে না। এ বিষয়গুলো ভেরি টেকনিক্যাল। টেকনিক্যাল যে সমস্যাগুলো থাকে সেগুলো আমরা সমাধানের চেষ্টা করি। এ পর্যন্ত গ্রিড সেভাবে আনস্টেবল হয়নি। আগের তদন্তগুলো মাথায় রেখে সেই পর্যায়ে ওই জায়গাগুলো স্টেবল করার জন্য। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, টেকনিক্যাল ফল্ট হতেই পারে। আমরা ধীরে ধীরে সিস্টেম অটোমেশনের দিকে যাচ্ছি। অটোমেশন হলে এ ধরনের ঘটনা কমে যাবে। ভবিষ্যতে এ ঘটনা আমাদের জন্য সতর্কবাণী হিসেবে কাজ করবে।