মলয় বিকাশ দেবনাথ ও রাকিব হাসান- বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্নিঝর এ মূহুর্তে কোনো কোনো উপক’লে আঘাত হানার অবস্থায় পৌঁছেছে। কিন্তু সিত্রাং গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত উপকূল থেকে ৩০০ কিঃমিঃ দূরে অবস্থান করছিল। এদিকে সিত্রাং এর প্রভাবে- খুলনায় বাঁধে ভাঙন, প্রবল বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বইছে ॥ সারা দেশে নৌ চলাচল বন্ধের নির্দেশ ॥ সিত্রাং এর আঘাতে উপকূলবর্তী ১৬ লাখেরও বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন ॥ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে খুলনা উপকূলে মাইকিং ॥ খুলনা শহরের অধিকাংশ রাস্তা-নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে ॥ সেন্টমার্টিনে ডুবে গেছে ১৫টি ট্রলার ॥ চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা, বন্দরে বিশেষ সতর্কতা জারি ॥ কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষনা ॥ বৃষ্টি মাথায় আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছে মানুষ ॥ মংলা-পায়রায় ৭, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত ॥ ভোর ৬টায় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র পটুয়াখালী-বরগুনা অতিক্রম করবে ॥ মঙ্গলবারের সব পরীক্ষা স্থগিত করল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ॥ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মনিটরিং সেল স্থাপন করা হয়েছে। এক দল বিশেষজ্ঞ তদারকির কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সার্বক্ষনিক তদারকিতে রয়েছেন||
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং নিয়ে ক্রমেই বাড়ছে শঙ্কা। মধ্যরাত থেকে উপকূলজুড়ে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মাঝেমধ্যে বয়ে যাচ্ছে দমকা হাওয়া। এর প্রভাবে খুলনায় রবিবার মধ্যরাত থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। খুলনায় দিবাগত রাত ১২টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার বার বিধ্বস্ত খুলনার কয়রা উপজেলার হরিণখোলা ও গাতিরঘেরী নামক স্থানে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দুপুরের জোয়ারের আগে কাজ করতে না পারলে ফসল, ঘরবাড়ি সব নোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে স্থানীয়রা। কয়রা পশ্চিম দেয়াড়া একতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক মো.তরিকুল ইসলাম বলেন, উপকূলজুড়ে ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হচ্ছে। দুটি স্থানে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ নেই। আশ্রয়কেন্দ্রে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থায় লাইট জ্বললেও মোবাইল চার্জিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে আবহাওয়া বার্তা পেতে সমস্যা হচ্ছে।
খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রার হরিণখোলা ও গাতিরঘেরীর বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের নিয়ে মেরামতের প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া কয়রার হোগলা, দোশহালিয়া, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট, ঘাটাখালী, গাববুনিয়া, আংটিহারা, ৪ নং কয়রা সুতির গেট ও মঠবাড়ির পবনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে নিজ নিজ এলাকার বাঁধের দিকে খেয়াল রাখার জন্য। সাইক্লোন শেল্টারগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ সকাল ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের অবস্থান মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ৫২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল। মোংলা সমুদ্র বন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, রবিবার মধ্যরাত থেকে ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এ দিন সকাল ৬টা পর্যন্ত ১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯ টা পর্যন্ত আরও ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। মধ্যরাত থেকে সকাল ৯ টা পর্যন্ত ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
কয়রা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বান্না জানান, ঘূর্ণিঝড় মঙ্গলবার ভোরের দিকে উপকূলে আঘাত হানতে পারে। সোমবার ভোর থেকে কয়রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যরাত থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় রিপোর্ট প্রদানে সমস্যা হচ্ছে।
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি এড়াতে জেলায় ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দাকোপে ১১৮, বটিয়াঘাটায় ২৭, কয়রায় ১১৭, ডুমুরিয়ায় ২৫, পাইকগাছায় ৩২, তেরখাদায় ২২, রূপসায় ৩৯, ফুলতলায় ১৩ ও দিঘলিয়ায় ১৬টি।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, মধ্যরাত থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা মাঠে কাজ করছেন। পাশাপাশি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাইকগাছা উপজেলার কোথাও বাঁধ ভাঙার সংবাদ পাইনি। তবে দুপুরের জোয়ারের পর সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা যাবে। খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রনজিৎ কুমার সরকার বলেন, ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আগতদের জন্য শুকনো খাবার, চাল ও টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আমরা সব প্রস্তুতি নিয়েছি।
সারা দেশে নৌ চলাচল বন্ধের নির্দেশ
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে সারা দেশে সব ধরনের নৌ-যান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ।
সোমবার সকালে বিআইডব্লিউটিএ’র জনসংযোগ কর্মকর্তা মোবারক হোসেন মজুমদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের জন্য নৌ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একইসঙ্গে সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া সমুদ্রে যে সকল জাহাজ যেখানে অবস্থান করছে, সেখান থেকে না সরতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।’
এদিকে বাংলাদেশ উপকূলের দিকে ক্রমশ ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে বরিশাল ও চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি। সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের বেশিরভাগ জেলায় ইতোমধ্যে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সবশেষ ৮ নম্বর বুলেটিনে দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে আগের ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
সিত্রাং এর আঘাতে উপকূলবর্তী ১৬ লাখেরও বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর প্রভাবে রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে উপকূল অঞ্চলে। এর ফলে দেশের সাত জেলা এখন বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ভোলাসহ সাতটি সমিতিরই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী এই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ঝড়ের ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই সময় তারা তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মোবাইলের ব্যবহার কমিয়ে চার্জ ধরে রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) জানায়, তাদের সব এলাকা ঝুঁকির মুখে নেই। তবে যে কয়টি জেলা পড়েছে সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু আছে। তবে ঝড়ো হাওয়ার কারণে কিছু এলাকায় এমনিতে বিদ্যুৎ বিতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। আরইবি জানায়, সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী আরইবির অধীন বরিশাল-১, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, খুলনা ও বাগেরহাট পিবিএস এর ১৬ লাখ ১২ হাজার গ্রাহক এখন বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থায় আছে। আরইবির চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের সাতটা পিবিএস ঝুঁকির মধ্যে আছে। তাই আপাতত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কিছু কিছু পিবিএস-এর হেড অফিসে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখা হয়েছে। যদিও তার পরিমাণ খুবই অল্প। ভোলায় একেবারেই বিদ্যুৎ নেই।
এই সাতটির বাইরেও বেশ কিছু পিবিএস ঝুঁকিতে আছে, যেমন কক্সবাজার। সেখানেও ঝড়ো হাওয়া বইছে। উপকূলের বেশিরভাগ এলাকায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হচ্ছে। তাই সবগুলোই ঝুঁকিরমধ্যে আছে।
প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সিত্রাং মোকাবিলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলার অভিজ্ঞতা সামনে রেখেই প্রস্তুতি নিয়েছি। মেরামতের সব ধরনের মালামাল, লোকবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফিডার ভিত্তিক কাজ বন্টন, লোকালের সাথে যোগাযোগ, টিম এরেঞ্জমেন্ট করা হচ্ছে। এছাড়া বলা হয়েছে, মোবাইলে কম কথা বলতে; যাতে করে চার্জ বেশিক্ষণ রাখা যায়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ভৌগোলিক এলাকা বাদে, খুলনা, বরিশাল ও বৃহত্তর ফরিদপুর বিভাগের ২১টি জেলা ও ২০টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওজোপাডিকো। ঝড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কিছু এলাকা এই ঝড়ের ঝুঁকির মধ্যে আছে। সেখানে আমরা সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। কিছু এলাকায় ঝরো হাওয়া ও বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হলেও এখনো কোথাও আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করিনি।’ প্রসঙ্গত, ওজোপাডিকোর অধীন বরিশাল বিভাগের ভান্ডারিয়া, নলছিটি, কাঁঠালিয়া, বোরহানউদ্দীন, চরফ্যাশন এবং মনপুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া খুলনা বিভাগের ফুলতলা, মোংলা, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর এবং মহেশপুরেও ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ আরও ঘনীভূত হয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। মঙ্গলবার ভোরে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। সোমবার সকালে ঝড়টি উপকূল থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, সাগর আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৪ (চার) নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৭ (সাত) নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরগুলোকেও ৬ (ছয়) নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ৭ (সাত) নম্বর বিপদ সংকেতের অর্থ হচ্ছে বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্ঝাবহুল এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেলে ৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরের উপর বা নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি মঙ্গলবার ভোরে বা সকাল নাগাদ পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার পাশ দিয়ে দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে। তবে সুপার সাইক্লোনটি প্রবল ঘূর্ণিঝরে রুপ নিতে পারে।
আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে খুলনা উপকূলে মাইকিং
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে খুলনা উপকূলে সকাল থেকে ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন দাকোপ-কয়রাসহ অন্যান্য উপজেলার মানুষ। উপকূলের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে সকাল থেকে শুরু হয়েছে মাইকিং। জেলার ৪০৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। সোমবার দুপুর আড়াইটায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নম্বর ০২৪-৭৭৭২৬৫৯২।
উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ আরও ঘনীভূত হয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। মঙ্গলবার ভোরে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এ কারণে কয়রা, মোংলা ও আশাশুনিসহ খুলনা উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিতে বলা হচ্ছে। খুলনার কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান বলেন, সাগর আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় মোংলায় সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এর পরই ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। কয়রায় ১০৮টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। ঝুকিপূর্ণ সবাইকে সন্ধ্যার আগেই আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে হবে।
বাগেরহাটের মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার বলেন, ‘মোংলার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে দুপুরের খাবার খেয়েই আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তাদের সন্ধ্যার আগেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে জোর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কারণ সিত্রাং ঝড়টি রাত ১২টার মধ্যে আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে।’ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে মধ্যরাত থেকে উপকূলে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া। খুলনা মহানগরের বিভিন্ন এলাকার ড্রেন ও রাস্তা পানিতে একাকার হয়ে গেছে। সিত্রাংয়ের প্রভাবে উপকূলের নদীগুলোতে পানির চাপ বেড়েছে। এর ফলে কয়রা ও সাতক্ষারীর আশাশুনির বিভিন্ন এলাকায় বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ধসে গেছে কয়রার হরিণখোলা বেড়িবাঁধ। এতে আতঙ্ক রয়েছেন উপকূলবাসী।
খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সার্বিক পরিস্থিতিতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ বলেন, ‘উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। মোংলা বন্দর থেকে এটি ৫২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। মোংলা বন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। তবে আশ্রয় কেন্দ্র, মেডিক্যাল টিম, পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রস্তুত রয়েছে।
প্রস্তুত ৭০৩০ আশ্রয়কেন্দ্র, নেওয়া হবে ২৫ লাখ মানুষ
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশে ধেয়ে আসার প্রেক্ষাপটে দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দিতে ৭ হাজার ৩০ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ২৫ লাখ মানুষ সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
সোমবার সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একসভা শেষে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।
এনামুর রহমান বলেন, ‘এটা (ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং) এরই মধ্যে সিভিয়ার সাইক্লোনে রূপ নিয়েছে। কেন্দ্র থেকে উপকূলের দূরত্ব ৪০০ কিলোমিটারের মতো এবং পেরিফেরি (ঘূর্ণিঝড়ের সীমানা) উপকূল থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মতো দূরত্বে আছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ আজ (সোমবার) সন্ধ্যায় আঘাত হানবে। আর মূল আঘাত হানবে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সকাল ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে।’
তিনি বলেন, ৭ হাজার ৩০টির মতো শেল্টার (আশ্রয়কেন্দ্র) প্রস্তুত করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ নেওয়ার কাজ সকাল থেকে শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে এটা আরও জোরদার করা হচ্ছে। আশাকরি, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার শতভাগ মানুষকে সরিয়ে আনতে পারবো। এরই মধ্যে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের প্রতিনিধিদের বলা হয়েছে, তারা যেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডকে সম্পৃক্ত করে। দুর্গম এলাকা থেকে লোকজন সরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তারা যেন সহযোগিতা করে। তারা এতে সম্মতি দিয়েছে- বলেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস ও রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কাজ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যারা আছে তারা তাদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আমরা এটুকু বলতে পারি সিত্রাং সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আঘাত হানবে। উপকূলীয় ১৩টি জেলায় বেশ মারাত্মকভাবে আঘাত হানবে। আর দুটি জেলায় হালকাভাবে আঘাত হানবে।
১৩ জেলার মধ্যে রয়েছে— বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফেনী।
এছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দ্বীপ অঞ্চল মহেশখালী, হাতিয়া, সন্দ্বীপ এগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ। এখান থেকে লোকজন সরিয়ে নিতে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। এরই মধ্যে আমাদের মানবিক সহায়তা যা আছে পৌঁছে দিয়েছি। শেল্টারের লোকজনকে আমরা দুপুরে, রাতের এবং আগামীকাল সকালে তিনবেলা খাবার দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি।
সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রতিমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় ১৫ জেলার কত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হবে? এর উত্তরে তিনি বলেন, আম্ফানে আমরা ২৪ লাখ ৭৬ হাজার মানুষকে শেল্টার দিয়েছিলাম। এবার আমরা ২৫ লাখের মতো টার্গেটে রেখেছি।
কতজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সব তথ্য এখনো পাইনি। এখনো এটা যোগ করিনি। সুতরাং এখনই বলা যাবে না। আমরা কন্ট্রোলরুমে গিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় যোগ করে জানাবো।
এটা কি সিডরের মতো ধ্বংসাত্মক হবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না। সিডর ছিল সুপার সাইক্লোন। সিভিয়ার সাইক্লোনের পর আর একটা স্তর আছে ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোন। তারপর সুপার সাইক্লোন। এটার বাতাসের গতিবেগ ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। এটাকে সিভিয়ার সাইক্লোন বলা হয়। এটা ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোন বা সুপার সাইক্লোন হওয়ার আপাতত কোনো প্রেডিকশন আমাদের নেই।
প্রধানমন্ত্রী কি নির্দেশনা দিয়েছেন? সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে এনে তাদের জীবনরক্ষা করা। একটি লোকও যদি মৃত্যুবরণ না করেন এটাই হবে বড় সফলতা। একই সঙ্গে গবাদিপশু রক্ষা করারও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কি পরিমাণ খাদ্য ও অর্থসহায়তা দেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা প্রতি জেলায় ৫ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছি। ড্রাই কেক এবং ড্রাই বিস্কুট পাঠিয়েছি। চাল, তেল, লবণ, চিনি, গুঁড়া মসলা পাঠিয়েছি। যাতে রান্না করে খাবার খেতে পারেন। বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ সর্বাত্মক রক্ষা করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে বলেও জানান ডা. মো. এনামুর রহমান।
খুলনা শহরের অধিকাংশ রাস্তা-নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে
ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’র প্রভাবে রবিবার রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে খুলনা শহরের অধিকাংশ রাস্তা ও নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে সড়ক আছে ১ হাজার ২১৫টি। এর দুই-তৃতীয়াংশ ডুবে গেছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিস জানায়, সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টি আরও বাড়বে এবং বাতাসের তীব্রতা থাকবে। সন্ধ্যা নাগাদ এটি তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। খানজাহান আলী সড়ক, কেডিএ এভিনিউ, যশোর রোড ও মজিদ সরণি, শান্তিধাম মোড়, রয়্যাল মোড়, বিআইডিসি রোডের আলমনগরসহ খুলনা নগরীর বিভিন্ন সড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে নৌকা চলাচলের অবস্থা তৈরি হয়েছে। আহসান আহম্মেদ রোড, শামসুর রহমান রোড, টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোড, বিআইডিসি রোড, শেখপাড়া গোবরচাকা, সোনাডাঙ্গা আবাসিক, মুজগুন্নি আবাসিক, নিরালা আবাসিক এলাকা প্রায় পুরোটাই ডুবে গেছে। খুলনা দৌলতপুরের সবুজ সংঘ মাঠ এলাকার বাসিন্দা তপন কুমার দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার বাড়ির সামনের ১৯ ফুট রাস্তা, কিন্তু সড়কের এক পাশে একটি মাত্র ড্রেন। সেটিও মাত্র ১ ফুট প্রস্থ। সামান্য বৃষ্টি হলেই ডুবে যায়। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করা এবং আরও বড় করা ছাড়া এই জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব না। নগরীর খালিশপুরের নতুন রাস্তার বাসিন্দারা বলেন, নগরীর অধিকাংশ সংযোগ সড়কে দীর্ঘ সময় পানি জমে থাকে। খালিশপুর হাউজিং পুরাতন ও নতুন কলোনির অপরিকল্পিত রাস্তা ও ড্রেনগুলো বছরের পর বছর সংস্কার ও পরিষ্কার না করায় বৃষ্টি হলেই ড্রেনের পানি উপচে বাসিন্দাদের ঘরে প্রবেশ করে।
খুলনা সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। প্রকল্প ব্যয় ছিল ৮২৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে। বর্তমানে ২৫টির অধিক ড্রেনের কাজ চলছে। তবে অতিবৃষ্টির কারণে কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে এবং অনেক অসমাপ্ত কাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সেন্টমার্টিনে ১৫ ট্রলার ডুবে গেছে
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সৃষ্ট ঝোড়ো হাওয়ায় সেন্টমার্টিনে নোঙর করে রাখা ১৫টি মাছ ধরা ট্রলার ডুবে গেছে। রবিবার রাত থেকে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনে দমকা হাওয়ার সঙ্গে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। উড়ে গেছে এই দ্বীপের বেশকিছু ঘরের চাল। নাফ নদসহ সাগরের পানি বেড়ে যাওয়ায় সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ আরও ঘনীভূত হয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। মঙ্গলবার ভোরে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানতে পারে। সোমবার সকাল থেকে উপকূলীয় বাসিদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে স্থানীয়দের আগ্রহ নেই বলে জানা গেছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ এরফানুলক হক চৌধুরী জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এই উপজেলায় ৭৮টি সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সেন্টমার্টিনের সকল হোটেল-মোটেল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাগরে বুকে জেগে উঠা সেন্টমার্টিন-শাহপরীর দ্বীপকে বিশেষ করে নজরে রেখেছি। এসব দ্বীপে জনসাধারণকে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে মাইকিং করে সচেতন করা হচ্ছে। তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুকনো খাবার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘ঘূণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সকাল থেকে প্রচন্ড হাওয়া শুরু হয়েছে। তবে ভাটার কারণে সাগরে পানি একটু কমেছে। ইতোমধ্য সাগরে আঘাতে জেটিতে নোঙরে থাকা ১৫টি ফিশিং ট্রলার ডুবে গেছে। তার মধ্য সাগরে ভেসে গেছে দুটি ট্রলার। বেশকিছু ঘরে চাল উড়ে গেছে। উপকূলের লোকজনকে সরিয়ে দ্বীপের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া জন্য মাইকিং চলছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ আশ্রয়কেন্দ্র যায়নি। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের দিয়ে দ্বীপের সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, সকাল থেকে দ্বীপে বাতাস বেড়েছে। দ্বীপের চেয়ারম্যানসহ একটি দল মাইকিং করে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন। এখনও মাইকিং চলছে, তবে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড় আসলে দ্বীপের বাসিন্দাদের নির্ঘুম রাত কাটে। কারণ সাগরের মাঝে আমাদের বসতি। এছাড়া আগের তুলনায় দ্বীপের অবস্থা ভালো না। সাগরে সামান্য পানি বাড়লে দ্বীপের চারদিকে ভেঙে যায়।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় জেলার উপকূলের বাসিন্দাদের নিরাপত্তায় ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিশেষ করে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জনগনের অসচেতনতাই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন বিশেষজ্ঞরা। বরাবরই স্থানীয় লোকজন এমন আচরন করে থাকেন।
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা, বন্দরে বিশেষ সতর্কতা জারি
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশের উপকূলের কাছাকাছি আসায় এর প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।এদিকে, সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নিজস্ব সংকেত ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন। সোমবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত এবং মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এই সতর্কতার পদক্ষেপ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য উঠানো-নামানোর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া সিত্রাং’র কারণে সাগর উত্তাল থাকায় বহিনোঙরেও পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে।
সংশিষ্ট সূএে জানা গেছে, লাইটার জাহাজগুলোকে কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর আশপাশে আনা হয়েছে। অপরদিকে বড় জাহাজগুলোকে গভীর সাগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বন্দরের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, আবহাওয়া অফিস থেকে ৬ নম্বর সংকেত জারির পর অ্যালার্ট-৩ জারির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপরই জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। জেটি থেকে পালাক্রমে জাহাজ সাগরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জেটিতে থাকা জাহাজে ব্যাপক আঘাত লাগে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে জাহাজ জেটি থেকে কিছুটা দূরে সাগরে পাঠানো হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে।
এদিকে, সাগর আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৪ (চার) নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৭ (সাত) নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ (ছয়) নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
সোমবার ভারি বর্ষণের সতর্কবাণীতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’র প্রভাবে সোমবার সকাল ১০টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক স্থানে ভারি (৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারি (৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও হতে পারে ভুমিধস। এরইমধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে। বইছে ঝড়ো হওয়া।
কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষনা
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার তাসনিম আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিকাল ৩টা থেকেই তারা এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করছেন। মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত বিমানবন্দরে কোনো উড়োজাহাজ ওঠানামা করবে না।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরও সোমবার সন্ধ্যা থেকে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান সিভিল এভিয়েশনের সদস্য (অপারেশন ও প্ল্যানিং) এয়ার কমডোর সাদিকুর রহমান চৌধুরী।
তিনি বলেন, “বিমানবন্দরগুলোতে আপৎকালীন প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আবহাওয়ার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এগিয়ে আসায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। উপকূলীয় জেলাগুলোতে চলছে ভারি বর্ষণ, জলোচ্ছ্বাসেরও পূর্বাভাস রয়েছে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, সোমবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার ভোররাতের মধ্যে খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে সিত্রাং।
চট্টগ্রাম নগরীর প্রান্তে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছেই শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের অবস্থান।
বিরূপ আবহাওয়ার কারণে সকাল থেকেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট কমিয়েছে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো। তবে শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম দুপুর পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই চলছে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেছেন, তারাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আবহাওয়া বিভাগের সাথে সমন্বয় করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মোংলা-পায়রায় ৭, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত
ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ বাংলাদেশের উপকূলের ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে। তাই মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
সোমবার ৮ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর নৌ-বিপৎসংকেত দেখাতে বলেছে অধিদপ্তর। এছাড়া অব্যাহত থাকতে পারে ভারি বৃষ্টি। উপকূলীয় এলাকায় নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৮ ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
৬ নম্বর বিপৎসংকেত মানে হলো বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্ঝাবহুল এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
৭ নম্বর বিপৎসংকেত হলো বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্ঝাবহুল এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। যাতে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরের ওপর বা নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছে। এটি সোমবার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত ও উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আগামীকাল ভোররাত বা সকাল নাগাদ খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
এতে আরও বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় বিক্ষুব্ধ রয়েছে সাগর।
মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে এর পরিবর্তে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে এর পরিবর্তে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৬ নম্বর বিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে।
আবহাওয়াবিদ খো. হাফিজুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৮ ফুটের বেশি উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ৫০-৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা বা ঝোড়ো বাতাস বয়ে যেতে পারে, সেইসঙ্গে ভারি (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারি (৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে বলেও জানান তিনি।
হাফিজুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদীবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর নৌ-বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে রবিবার থেকেই বাংলাদেশে সিত্রাংয়ের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হচ্ছে বৃষ্টি। উপকূলীয় এলাকায় বইছে দমকা হাওয়া। আবহাওয়া দপ্তর সোমবার উপকূলীয় অঞ্চলে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে।
রবিবার সকালে থেকে সারাদিনই ঢাকার আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, রাত থেকে ঢাকায় হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। সোমবারও আকাশ মেঘে ঢেকে রয়েছে, বেলা বাড়ার সঙ্গে বৃষ্টির মাত্রাও বাড়ছে।
তাণ্ডব চলছে দেশেজুড়ে
সিত্রাং সিভিয়ার সাইক্লোনে রূপ নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশজুড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণের খবর পাওয়া গেছে।
সোমবার দিনগত রাত থেকে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরসমূহকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ঢাকা
সকালে ঘুম ভেঙেই রাজধানীবাসী পড়েছেন বৃষ্টির কবলে। হালকা থেকে মাঝারি, মাঝেমধ্যে হওয়া ভারী বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে মুষলধারে এ বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
এতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় যান চলাচল ব্যাহত হয়েছে। যানবাহনে মানুষের ভীড়ও কম দেখা গিয়েছে।
জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া সাধারণ মানুষ বৃষ্টিতে বিপাকে পড়ে। এ ছাড়া বৃষ্টিতে দুর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষেরাও।
চট্টগ্রাম
উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় ১৫ উপজেলায় ২৯০টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রেখেছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। ঘূর্ণিঝড় পূর্ববর্তী, ঘূর্ণিঝড়কালীন এবং পরবর্তীতে যেকোনো ধরনের সেবা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিশেষ কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে।
খুলনা
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে উপকূলীয় জনপদ খুলনায় বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। সোমবার দিনভর প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে উপকূলীয় মানুষের মনে আতঙ্ক বাড়ছে। অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শহরের অধিকাংশ সড়কে হাঁটু পানি জমেছে। জেলার ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ জনের জন্য ৪০৯টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বাগেরহাট
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মোংলা বন্দরে অবস্থানরত দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহণ বন্ধ রয়েছে। সোমবার (২৪ অক্টোবর) দুপুরে মোংলা বন্দরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যালার্ট-৩’ জারির পর পণ্য বোঝাই খালাস বন্ধ করা হয়।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপসচিব (বোর্ড ও জনসংযোগ বিভাগ) মো. মাকরুজ্জামান বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৭ নম্বর বিপৎসংকেত জারির পর বন্দরে অ্যালার্ট-৩ জারি করা হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সকাল থেকে পণ্য ওঠা নামার সকল কাজ বন্ধ রয়েছে। বন্দর জটিতে থাকা সকল জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বহির্নোঙরে।
বরিশাল
বৈরি আবহাওয়ার কারণে বরিশাল নদী বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ ও দুরপাল্লার সকল রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে বরিশালে বর্তমানে বাতাসের গতিবেগ ২০ নটিক্যাল মাইল থাকলেও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ৭০ নটিক্যাল মাইল। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের গতিবেগও বাড়তে থাকবে।
উপকূলীয় মানুষকে নিরাপদে নেওয়ার জন্য বিভাগের ৩ হাজার ৯৭৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবার এবং ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে।
ভোলা
ভোলায় সকাল থেকে ১ মিলিমিটারের কিছুটা কম বৃষ্টি হয়েছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বিরাজ করছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় জেলায় ৬৯১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। সেগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৫ লাখ ২৩ জন।
পটুয়াখালী
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং, পটুয়াখালী জেলায় সকল ধরনের নৌ চলাচল ও বিদুৎ বন্ধ রয়েছে। এতে জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব পরেছে। কুয়াকাটার বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে।
উপকূলীয় এলাকার জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে বা সাইক্লোন শেল্টার যাওয়ার জন্য প্রচার করছে কোস্ট গার্ড, রেড ক্রিসেন্ট, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিপিপি।
ফেনী
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে। সোনাগাজীর উপকূলীয় এলাকায় থেমে থেমে ঝড়ো হাওয়া বইছে। বৃষ্টি ও ঝড়ো হওয়ার ফলে ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঠের ধান। উপজেলার জেলে পাড়া, আদর্শ গ্রাম, মুহুরী প্রজেক্ট, ধান গবেষণা ও সোনাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মাঠের ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে ফেনী জেলা প্রশাসন। ফেনীর সোনাগাজীর উপকূলে দুর্যোগ মোকাবিলায় বিদ্যুৎ, ফায়ার, সিপিপি, স্বাস্থ্য বিভাগ, বন বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনেরসহ সকল বিভাগ শুধু প্রস্তুত নয় বরং স্ব স্ব অবস্থান থেকে দায়িত্বপালন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আব সেলিম মাহমুদ- উল হাসান বলেন, ‘দুর্যোগ চলাকালীন আশ্রয় কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় খাবারের সুসম বণ্টন, জরুরি স্বাস্থ্য সেবা ও আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং নামটি দিয়েছে থাইল্যান্ড। ২০১৮ সালের পর অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া প্রথম ঝড় এটি।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সিত্রাং মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে আঘাত হানবে। এটা উত্তর পশ্চিম থেকে নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে চলে আসছে। সিত্রাং এখন পুরোটাই বাংলাদেশের ওপর আঘাত হানবে।
ভোর ৬টায় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র পটুয়াখালী-বরগুনা অতিক্রম করবে
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’র অগ্রভাগ সোমবার সন্ধ্যায় দেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানবে। এর কেন্দ্র আঘাত করবে আগামীকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টায়।
সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি গতি পরিবর্তন করে শুধুমাত্র বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মন্ত্রী আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৩ জেলায় প্রবলভাবে আঘাত করবে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা দিয়ে অতিক্রম করবে বলে জানান তিনি।
১৫ জেলায় ৭ হাজার ৩০ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে’ উল্লেখ করে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘সেখানে ২৫ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন।
মঙ্গলবারের সব পরীক্ষা স্থগিত করল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য মঙ্গলবারের সকল পরীক্ষা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে স্থগিত করা হয়েছে।
সোমবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক মো. আতাউর রহমানের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, স্থগিত পরীক্ষার সংশোধিত সময়সূচি সংশ্লিষ্ট সকলকে পরে জানানো হবে। এছাড়া এ সকল পরীক্ষার পূর্বঘোষিত অন্যান্য তারিখ ও সময়সূচি অপরিবর্তিত থাকবে।