স্টাফ রিপোর্টার- বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থ ফেরতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ ১০ দেশের সঙ্গে আইনগত সহায়তা চুক্তির (এমএলএ) বাইরে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বিষয়গুলোও প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে বলেছেন আদালত।
পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরানোর বিষয়ে চুক্তি সইয়ের যৌক্তিকতা সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানানোর পর বুধবার তা হাইকোর্টে উপস্থাপন করা হয়।
পরে এ বিষয়ে শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এদিন আদালতে বিএফআইইউয়ের পক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আন্না খানম কলী। অন্যদিকে দুদকের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান।
আইনজীবীরা জানান, অর্থপাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ ১০ দেশের সঙ্গে এমএলএ চুক্তি সইয়ের উদ্যোগ নিতে আরও তিন মাস সময় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
মঙ্গলবার এমএলএ চুক্তি সইয়ের উদ্যোগ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে দাখিল করে বিএফআইইউ জানায়, অর্থপাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ ১০ দেশের সঙ্গে আইনগত সহায়তা চুক্তি (এমএলএ) সইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে এ চুক্তি সইয়ের যৌক্তিকতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অবহিত করা হয়েছে।
একই সঙ্গে অর্থপাচার রোধে রিসার্চ সেল গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এমএলএ চুক্তি সইয়ের অনুরোধ করেছে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউ।
হেড অব বিএফআইইউয়ের (প্রধান কর্মকর্তা) মো. মাসুদ বিশ্বাসের সই করা প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়।
হাইকোর্টে দাখিল করা বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য অন্তত ১০ দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি (এমএলএ) সইয়ের যৌক্তিকতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অবহিত করেছে বিএফআইইউ।
দেশগুলো হলো- কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং-চায়না।
এদিন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করবেন।
মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি হলফনামা করা হয়েছে। বুধবার এ হলফনামা হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক জাগো নিউজেক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিদেশে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য প্রস্তাবিত ‘রিসার্চ সেল’-এ লোকবল পদায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক এ সেলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপযুক্ত লোকবল পদায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
পাচার অর্থ ফেরত আনা সম্পর্কে এতে বলা হয়, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনা সম্পর্কিত মামলায় তথ্য-প্রমাণ বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে যথাসময়ে না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের ষষ্ঠ সভা গত ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভায় বাংলাদেশ থেকে পাচার অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য ১০ দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি (এমএলএ) সইয়ের বিষয়টি পর্যালোচনার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অংশগ্রহণে সভা আয়োজন করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ সিদ্ধান্তের সূত্রে বিএফআইইউ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়কে সভা আয়োজনের অনুরোধ করে। পরবর্তীসময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কোন কোন দেশের সঙ্গে এ পর্যায়ে এমএলএ চুক্তি সই করতে হবে এবং এর যৌক্তিকতা জানানোর জন্য বিএফআইইউকে অনুরোধ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিএফআইইউ উল্লিখিত ১০ দেশের সঙ্গে এমএলএ চুক্তি সইয়ের যৌক্তিকতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানায়।
এ সংক্রান্ত ভারতীয় রায় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইকোর্টের পরামর্শ মোতাবেক ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রামজিৎ মালানি বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড আদার্স শীর্ষক মামলার রায় সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এছাড়া ভারতের নেওয়া ব্যবস্থার অনুরূপ ব্যবস্থা বাংলাদেশেও আইনানুগভাবে নেওয়া যায় কি না, তা পর্যালোচনার সুপারিশ সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে প্রস্তুত করা কৌশলপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে প্রস্তুতকৃত কৌশলপত্র বা প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির ৩০ আগস্টের অনুষ্ঠিত ২৬তম সভার আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি জাতীয় সমন্বয় কমিটির পরবর্তীসভায় আলোচনা ও অনুমোদন পাবে বলে আশা করছে বিএফআইউ। গত ১০ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি শুয়ার্ড অর্থপাচার ইস্যুতে কথা বলেন।
ওইদিন সুইস রাষ্ট্রদূত বলেন, সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য তথ্য চায়নি। সুইস ব্যাংকের ত্রুটি সংশোধনে সুইজারল্যান্ড কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তবে আমি আপনাদের জানাতে চাই, সুইজারল্যান্ড ‘কালো টাকা’ রাখার কোনো নিরাপদ ক্ষেত্র নয়।
তিনি বলেন, গত বছর সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে। তবে উভয় দেশের সম্মতিতে ব্যাংকিং তথ্য লেনদেন হতে পারে এবং সেটা সম্ভবও। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
এরপর গত ১১ আগস্ট বিষয়টি নজরে নিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমাকারীদের তথ্য কেন জানতে চাওয়া হয়নি, তা স্বপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জানাতে বলেন হাইকোর্ট।
পরে আদালতে দুদক এবং বিএফআইউয়ের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ হলফনামা আকারে তথ্য জমা দেয়। ওই হলফনামায় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় বিএফআইউ প্রধানকে তলব করা হয়।
সেই তলবে ৩১ আগস্ট হাজির হয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুরসণ না করায় বিএফআইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ক্ষমা চান। পরে আদালত তাকে সতর্ক করে দেন।
ওইদিন অর্থপাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত ভারতের ‘রামজিৎ মালানি বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ মামলার রায় পড়ার পরামর্শ দিয়ে বিএফআইইউ প্রধানের উদ্দেশে আদালত বলেন, কেবল চিঠি চালাচালিই (বিভিন্ন দেশের এফআইইউকে) যথেষ্ট নয়। আইনের মধ্যে যথাযথ প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ না করলে ৫০ বছরেও পারবেন (অর্থপাচার ও পাচারকারীদের তথ্য) না।
তখন মাসুদ বিশ্বাস বিএফআইইউয়ের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, ২০১৭ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দুদক, এনবিআর এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এ পর্যন্ত ৯৮৩টি ইন্টেলিজেন্স প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, বিদেশে ৬৪৪টি অনুরোধ পেয়েছি। ১২৮টি রিসিভ করেছি। ৭৯ বার এফআইইউ টু এফআইইউ যোগাযোগ হয়েছে।
তখন আদালত এফআইইউ টু এফআইইউ চুক্তি হওয়া উচিত বলে অভিমত দিয়ে বলেন, ভারত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে ৭৮৪ জনের টাকা ফেরত এনেছে। ভারত পারলে আমরা কেন পারবো না? কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন আমাদের জানান। গবেষণা সেল তৈরি করেন। সেল তৈরি করে আমাদের জানান। দেশের স্বার্থে আপনাকে ডেকেছি, আমরা যা করি দেশ ও জনগণের কল্যাণে করি।
একইসঙ্গে বিএফআইইউ কোন কোন দেশের কাছে অর্থপাচার ও পাচারকারীদের তথ্য চেয়েছে, কী তথ্য পেয়েছে, তথ্য পেয়ে থাকলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এবং পাচার করা অর্থ উদ্ধারে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে ২৬ অক্টোবর পরবর্তী আদেশের জন্য রাখেন। এ আদেশ অনুসারে মঙ্গলবার বিএফআইইউ প্রতিবেদন হলফনামা করেন।