স্টাফ রিপোর্টার – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আবারও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবেন তা নিশ্চিতই ছিল। দশে ১০ বার যে তিনি সভাপতি হবেন, তা সবাই জানত। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরও যে হ্যাটট্রিক সাধারণ সম্পাদক হতে চলেছেন, তাও বোঝা যাচ্ছিল। তবে ঘোষনার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। যদি কোন চমক শেষমুহুর্তে দেখা দেয়। তা হলো না। ওবায়দুল কাদেরই আবার সাধারণ সম্পাদক হলেন। তাতে করে শেখ হাসিনা দশে ১০ বার সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের টানা তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন।
আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় শনিবার বিকেলে। ৩ টায় রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সম্মেলনের এই অধিবেশনের উদ্বোধন করেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়।
কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন হয় দুপুরে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ শেষে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা প্রথম অধিবেশনের মুলতবি করছি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে দ্বিতীয় অধিবেশন বসবে। সেখানে নতুন নেতৃত্ব আসবে। আজকে থেকে আমাদের বিদায়। সবাই ভালো থাকবেন। দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে মঞ্চে শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
কাউন্সিল অধিবেশনের শুরুতে আট বিভাগের আটটি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য দেন। তার শুরু হয় রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলা দিয়ে। উদ্বোধন অনুষ্ঠান উন্মুক্ত হলেও কাউন্সিলে কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকরাই অংশ নিতে পারেন। অধিবেশনে প্রত্যেক বিভাগ থেকে দলের একজন করে নেতা বক্তব্য রাখেন। কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নেতৃত্ব নির্বাচন অর্থাৎ নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি (কার্যনির্বাহী সংসদ) নির্বাচন হয়। এর আগে পুরোনো কমিটি বিলুপ্ত করে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। কমিশনের অন্য দুই সদস্য হলেন – মশিউর রহমান ও সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। এ অধিবেষণে ৭ হাজার কাউন্সিলর অংশ নেয়।
আওয়ামী লীগের ১০ম জাতীয় সম্মেলন ১১২ সার্কিট হাউজ রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালের ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা দলের পদে থাকতে পারবেন না। ফলে বঙ্গবন্ধু দলীয় সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দলের সভাপতি হন এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান।
এরপরই ঘটে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই ভয়াবহ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হন সপরিবারে। সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর কারাগারের ভেতরে নিহত হন আওয়ামী লীগের চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলী। দলটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুঃসময় এসে হাজির হয়।
এমন একটি পরিস্থিতিতে ১৯৭৭ সালের ৩ থেকে ৪ এপ্রিল হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে দলের ১১তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কাউন্সিলর ছিলেন প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন এবং ডেলিগেটও সমসংখ্যক ছিল। এতে দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন।
এর পরের বছর ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১২তম জাতীয় সম্মেলন। ৩ থেকে ৫ মার্চ হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কাউন্সিলর এবং সমসংখ্যক ডেলিগেট নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনটি। এতে সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল মালেক এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আবদুর রাজ্জাক।
১৯৮১ সালের ১৩তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। শুরু হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পথ চলা। সেই যে শুরু। দলীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য এ সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্বে আনা হয় বঙ্গবন্ধু কন্যাকে। ’৮১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট ছিল ৩ হাজার ৮৮৪ জন। সভায় শেখ হাসিনা সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাক দলত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। দলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
১৯৮৭ সালের ১ থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ১৪তম জাতীয় সম্মেলন। এতে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট ছিল প্রায় ৪ হাজার। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এরপর ১৯৯২ সালের ১৯ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলের ১৫তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ দুই বছর থেকে বাড়িয়ে তিন বছর মেয়াদী করা হয়। এতে কাউন্সিলর ছিল প্রায় ২ হাজার ৫০০ ও ডেলিগেটও ছিল সম সংখ্যক। তাতে শেখ হাসিনা সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ১৬তম জাতীয় সম্মেলন আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রায় ২১ বছর পর দলটি ক্ষমতায় আসার পরে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সম্মেলন। ৬ থেকে ৭ মে আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে কাউন্সিলর ছিল ২ হাজার ৫১৬ এবং ডেলিগেটও ছিল সমসংখ্যক। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পুনঃনির্বাচিত হন শেখ হাসিনা ও জিল্লুর রহমান।
২০০২ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে, তখন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় দলের ১৭তম জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুল জলিল।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১৮তম জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
২০১২ সালে ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১৯তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পুননির্বাচিত হন শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর দুই দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এখান থেকেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরেরও পথ চলা শুরু হয়।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক পুণনির্বাচিত হন। এবার তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন কাদের। আর শেখ হাসিনা টানা ১০ বার সভাপতি হলেন।