রবিবার, ২২শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

একাকিত্বের সমাজে আমরা: সংযোগের যুগে বিচ্ছিন্ন মানুষ

একাকিত্বের

একাকিত্বের সমাজে আমরা: সংযোগের যুগে বিচ্ছিন্ন মানুষ
আজকের পৃথিবী তথ্য ও প্রযুক্তির জয়যাত্রায় অভূতপূর্ব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্মার্টফোন—সবকিছুই মানুষকে যুক্ত করেছে এক অপার ভার্চুয়াল জগতে। যেকোনো মুহূর্তে আমরা বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি, খবর নিতে পারি প্রিয়জনের, ভাগাভাগি করতে পারি জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভব। অথচ, এতো ‘সংযুক্তির যুগেও’ আমাদের সমাজে বেড়েই চলেছে একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা আর নিঃসঙ্গতা।

এই একাকিত্ব যেন এক নীরব মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে। শহরের ফ্ল্যাটবদ্ধ জীবনে, কর্মক্ষেত্রের কর্মব্যস্ততায় কিংবা তরুণদের ভার্চুয়াল জগতে—সবখানে মানুষ আজ ঘিরে আছে মানুষের দ্বারা, কিন্তু অনুভব করছে এক গাঢ় শূন্যতা।

এক সময় ছিল, বিকেলে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাড়ার কারও সঙ্গে গল্পে মেতে উঠত মানুষ। সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই বসত একসাথে, কেউ রেডিও শুনত, কেউ গল্প বলত, কেউ চা খেতে খেতে ব্যস্ত দিনের ক্লান্তি ভাগাভাগি করত। এখন সে জায়গায় এসেছে ব্যক্তিগত ডিভাইস, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, ইয়ারফোন আর ‘নোটিফিকেশন’। এতে করে একেকজন মানুষ যেন তার নিজের জগতে বন্দী হয়ে গেছে।

আমরা ‘শেয়ার’ করছি অনেক কিছুই, কিন্তু ভাগ করে নিচ্ছি না কিছুই। ফেসবুকে হাজার ‘ফ্রেন্ড’, ইনস্টাগ্রামে শত শত ‘ফলোয়ার’—তবুও একজন সত্যিকারের শ্রোতা, একজন নিঃস্বার্থ বন্ধু খুঁজে পাওয়া আজ বিরল।

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এই ভার্চুয়াল সংযুক্তির ফাঁদে পড়ে বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো হারিয়ে ফেলছে। তারা মোবাইল স্ক্রিনে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটায়, অথচ বাসার পাশের বন্ধুটা কী করছে, বাবা-মা আজ সারাদিন কেমন ছিলেন—সেই খোঁজ নেয় না। প্রেম-ভালোবাসাও হয়ে গেছে ‘ইনবক্স নির্ভর’, একবার রিপ্লাই না আসলেই সম্পর্কে ফাটল।

এই একাকিত্ব শুধু আবেগের জায়গায় নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, দীর্ঘস্থায়ী নিঃসঙ্গতা মানুষের হতাশা, উদ্বেগ, ডিপ্রেশন এমনকি আত্মহত্যার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশেও আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যার পেছনে অন্যতম কারণ হলো মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলা এবং একাকিত্ব।

তরুণরা আজ অনেক কিছু জানে, কিন্তু কাউকে জানাতে চায় না নিজের অনুভবের কথা। কারণ তারা বিশ্বাস করতে শেখেনি যে কেউ নিঃস্বার্থভাবে শোনার জন্য থাকবে। পরিবার, সমাজ কিংবা বন্ধুরা—সবাই যেন ব্যস্ত, ছুটছে নিজের লক্ষ্যের পেছনে।

শুধু ব্যক্তিজীবন নয়, এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের সামষ্টিক জীবনেও প্রতিফলিত হচ্ছে। এক সময় প্রতিবেশীরা ছিল পরিবারসম, এখন একই ভবনের ফ্ল্যাটে বছরের পর বছর থেকেও কেউ কাউকে চিনে না। একসাথে উৎসব করার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, জায়গা নিচ্ছে ‘নিজের মতো করে থাকা’র প্রবণতা।

এমনকি ধর্মীয় ও নৈতিক চর্চাও এখন অনেকাংশেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। আমরা এখন আর মসজিদে বা মন্দিরে গিয়ে একত্রে সময় কাটাই না, বরং মোবাইলেই শুনে নিই বয়ান কিংবা আরাধনার আয়োজন। এতে হয়তো সময় বাঁচছে, কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে একসাথে থাকার মানবিক সৌন্দর্য, সামাজিকতা, ভাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সম্পর্ক ও শ্রদ্ধাবোধ।

তবে প্রশ্ন আসে, এই একাকিত্ব থেকে কীভাবে বের হওয়া সম্ভব? এর একমাত্র সমাধান—আবার ফিরে আসা মানুষের কাছে। প্রযুক্তি থাকুক, কিন্তু তা যেন সম্পর্কের বিকল্প না হয়।

আমাদের দরকার আবার বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতে শেখা, পরিবারকে সময় দেওয়া, অকারণেই কারও পাশে দাঁড়ানো। একজন বন্ধুকে ফোন করে বলা, “কেমন আছিস?”, বাবা-মায়ের মুখোমুখি বসে চা খাওয়া, সন্তানকে জড়িয়ে ধরা—এই ছোট ছোট কাজগুলোই একাকিত্বের দেয়াল ভেঙে দিতে পারে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। বন্ধুত্ব, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা যেন শুধু পাঠ্যবইয়ের শব্দ না থাকে, বাস্তব জীবনের চর্চার অংশ হয়।

পত্রপত্রিকা, মিডিয়া, নাটক-সিনেমা, সব জায়গায় সম্পর্কের সৌন্দর্য, পারিবারিক বন্ধন ও মানবিক সংযোগের গল্প বাড়াতে হবে। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি এক সময় মানুষকে একত্র করত। সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।

পরিশেষে বলা যায়, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে চারপাশে যত প্রযুক্তি, ততটাই শূন্যতা। মানুষ ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছে, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও যোগাযোগ কমে যাচ্ছে, অনুভব লুকিয়ে রাখছে। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীব। সে একা থাকতে পারে না।

এই একাকিত্বের সমাজে আমরা যদি একটু মানবিক হই, একটু মনোযোগী হই অন্যের জীবনের প্রতি, তাহলে এই নিঃসঙ্গতা এক সময় আর থাকবে না।

হয়তো তখন আর কেউ বলবে না, “আমি একা”, বরং বলবে—“তুমি পাশে আছো, এটাই যথেষ্ট।”

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ