মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ :
বাবা! শব্দটির মধ্যে বিশালতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। পাওয়া যায় নির্ভরতার আলিঙ্গন। বাবা মানে আশ্রয়। বাবা মানে একটি বৃক্ষ। বাবা মানে এক টুকরো ছাদ। মাথার ওপর বিশাল আকাশ। বাবা কখনো সন্তানকে বুঝতে দেন না কীভাবে তিনি তার সন্তানের মুখে অন্ন জোগান দেন।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশেও এই দিবস পালিত হয়। একটি বিশেষ দিনে আমরা বাবাকে স্মরণ করি। জড়িয়ে ধরে বলি, বাবা তোমাকে ভালোবাসি। কখনও কোনো উপহার কিনে দেওয়া না হলেও বাবা দিবসে বাবাকে তার পছন্দের উপহার কিনে দেই।
বিশ্ব বাবা দিবস উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বাবাদের সঙ্গে তোলা ছবি শেয়ার করেছেন সবাই। সেই সঙ্গে বাবাকে নিয়ে প্রকাশ করেছেন মনের অনুভূতি। জানিয়েছেন শুভকামনা।
বিশ্বজুড়ে বাবা দিবসকে ঘিরে সন্তানদের আগ্রহ, উৎসাহ ও উদযাপনের বৈচিত্র্যে কোনো কমতি নেই। পিছিয়ে নেই পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। জানিয়েছেন তাদের সেই অনুভূতির কথা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের পনেরোতম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিফাত চৌধুরী সজল বলেন, বাবারা হয় ছায়ার মতো, যে ছায়াতলে থেকে সন্তানের সারাজীবন অনায়াসে কেটে যায়। বটগাছের মতো আগলে রাখে। তবে আমার ছায়া মাথার উপর থেকে চলে যায় ছোট্টবেলায়। বাবারা যাওয়ার সাথে সাথে সব বায়না শেষ হয়ে যায়। আমার কাছে বাবা দিবস বলে তাই আলাদা কিছু নেই! প্রতিদিন আমি বাবাকে ফিল করি। আমি জানি বাবা যেখানেই থাকুক, বাবার ছায়া অদৃশ্য হয়ে মাথার উপর আছে সবসময়।
বাবার প্রতি আমার অনুভূতির শেষ নেই। বাবা অনেক ব্যস্ত থাকেন, তবুও বুঝতে দেন না কখনো। মাঝে মাঝে বাবাকে খুব বলতে ইচ্ছা করে বাবা তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসি। আমার মাঝেই বাবা আছেন। অনেক ভালোবাসি তোমায়! কখনো বলার সুযোগ হয় নাই। আর কখনো বলতেও পারব না। তবু বারবার বলতে ইচ্ছা করে অনেক ভালোবাসি তোমায় বাবা! আমার মনে হয় বাবাতো বাবাই, বাবাকে সারাজীবন ভালোবাসা উচিৎ। বাবার ভালোবাসা একদিন নয় প্রতিদিন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের চৌদ্দতম ব্যাচের শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিদ ফাইয়াজ বলেন, বাবা নামটাই কেমন ভার ভার! বাবা ঠিক মা নয়। বাইরে বেশি থাকেন। কঠিন চেহারা, শক্ত চোয়াল আর অত সহজেও হাসেন না। আর এই বাবাকে কোনো না কোনো দিন চিনে ফেলে সন্তান। বাইরে তিনি যতটাই কঠিন, ভেতরে ততটাই কোমল। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজের বর্তমানের হাসিমুখকে উৎসর্গ করে দেয় এই বাবারা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পনেরোতম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ বলেন, পৃথিবীর সব মাই ভালো মা। কিন্তু পৃথিবীর সব বাবাই ভালো বাবা নন। সম্ভবত মা হলেন একমাত্র ব্যক্তি, যার ভালো হবার পেছনে কারণ লাগে না, যাকে ভালোবাসার জন্য শর্ত প্রযোজ্য হয় না। কিন্তু বাবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় শর্ত। বাবা যদি ঠিক মতো আয়-রোজগার করতে না পারেন, চাহিদামতো কাপড়-চোপড়, কম্পিউটার-ঘড়ি-মোবাইল, কসমেটিক্স ইত্যাদি কিনে দিতে না পারেন, ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে না পারেন, দেশ-বিদেশ ঘোরাতে না পারেন, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য খেয়ে না খেয়ে আগাম সঞ্চয় করে রাখতে না পারেন- তিনি কোনোমতেই ভালো বাবা নন। অতএব, বাবা সম্পর্কটার সাথে ‘শর্ত প্রযোজ্য’। শুধু শর্তই নয়, কড়াকড়ি শর্ত প্রযোজ্য।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা হলেন একটা পরিবারের খুব কম পারিশ্রমিকের বা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকের মজুর খাটা কাজের লোক। দায়িত্বের গুরুভার মাথায় নিয়ে এক নিঃসঙ্গ সারথী, যার কাজ সন্তানদের সবাইকে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে একাকি পরপারে যাবার জন্য অলসভাবে অপেক্ষা করা। আমরা একটা মানুষের প্রতি প্রতিনিয়ত ‘এটা দাও, ওটা আনো, সেটা নাই কেন?’ ইত্যকার দাবি-দাওয়া ছুঁড়ে দিতে থাকি, সেই মানুষটা এত এত দাও, আনো, নাই-এর মোকাবিলা একা হাতে কী করে করবেন– একবারও ভেবে দেখি না। সেই মানুষটা যতক্ষণ উপার্জন করছেন, দু’হাতে উপার্জন করছেন, ততক্ষণই তিনি আদর্শ বাবা। কিন্তু যদি ঐ চাহিদাগুলো পূরণ করতে না পারেন – আই হেইট ইউ বাবা, তুমি আমার কোনো আবদারই রাখনি বাবা! আর তাদের অবাধ স্বাধীনতা না দিলে ব্যাকডেটেড, দিয়ে ফেললে ব্যর্থ অভিভাবক।
আপনি তাদের সব কাজে সমর্থন করলে, ‘বাবা তো কিছুই বোঝে না, খালি হ্যাঁ-এর সাথে হ্যাঁ মিলিয়ে যায়!; সমর্থন না করলে, ‘বাবা তো কিছুই বোঝে না, খামাখা সবটাতে বাগড়া দেয়!’ বাবা হলেন সেই ব্যক্তি, যাকে সবচেয়ে সহজে ভুল বোঝা যায়, যাকে খুব সহজেই ধরে নেওয়া হয়, সবচেয়ে ভুলভাবে উপস্থাপন করা যায়–অন্যের কাছে তো বটেই, এমনকি নিজের কাছেও। বাবা হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ চরিত্র, যাকে সঙ্গ দেওয়াটা আদিক্ষেতা, অথচ তাঁর সঙ্গ না পাওয়াটা নাকি তাঁরই কর্মফল!
মায়ের প্রতি সন্তানের আচরণ হলো ভালোবাসা। কিন্তু বাবার প্রতি সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্তব্য, শ্রদ্ধা, ভয়, প্রতিদান, পুরস্কার এবং কখনো কখনো শুধুই দায়শোধ! আর ঠিক এজন্যই মনে হয়, বছরে একটা দিন বাবা দিবস থাকা খুব জরুরি, যেদিন সংসারের এই কলুর বলদটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়–আরে, তুমি তো আমাদেরই একজন, এত মন ছোট করে থাকো কেন? সত্যি বলতে সংসারে বাবার কদর একেবারেই নেই তাও না। বাবা’র কদর বাড়ে বাবা মরে গেলে! সে অবশ্য মরে গেলে যেকোনো মানুষের কদরই কিছু না কিছু বাড়ে, এক্ষেত্রেও বাবা চরিত্রটা ব্যতিক্রম হতে পারলো না!
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জারিফ তাজওয়ার বলেন, বাবা শব্দটা শুনতে খুব ছোট হলেও এর মূল্য অনেক। আমাদের ভবিষ্যত গড়ার পেছনে যার সব থেকে বড় অবদান সে হলো বাবা। ত্যাগের সংজ্ঞা শুধুমাত্র একজন বাবা বলতে পারবে। যাদের এক জামাতে এক বছর চলে যায়, কিন্তু কখনো পুরাতন হয় না। আর জুতা তাতো সম্ভবত এক যুগ চালানোর চেষ্টা করে। পটেকে টাকা আছে জেনেও যে মানুষটা নিজের তৃপ্তির জন্য চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা খায় না, সে মানুষটি হলো বাবা।
‘বাবা আমার কিছু টাকা লাগবে কাল বই কিনতে হবে’ সন্তানের এ কথা শুনার পর যে মানুষটি পটেকে টাকা আছে কি না না জেনে বলে খোকা দিচ্ছি টাকা, তুমি শুধু মন দিয়ে পড়। একটা মানুষ সবসময় আমাদের কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে তা শিক্ষা দেন, সে মানুষটি হলো বাবা।
আজ মনে পড়ছে সেই স্কুলজীবনের প্রথম দিনটির কথা, যখন বাবার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছিলাম, বাবা বলতেছিল খোকা তোমায় অনেক বড় হতে হবে। তুমি যত বড় হও, তুমি মানুষের মত মানুষ হও, যেন আমি তোমায় নিয়ে গর্ব করতে পারি। একথাগুলো শুধুমাত্র বাবারাই বলবে। নামাজের পর মোনাজাতে সন্তানের সুস্থতা কামনা তা শুধু বাবাই করবে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।