মোল্লা জালাল
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবের কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী দেশের আর্থ-সামজিক সকল ক্ষেত্রে কৃচ্ছতা সাধন করতে বলেছেন। তিনি বলছেন, অপরিকল্পিত ব্যয় বন্ধ করতে। শুধু তা-ই নয়,সরকারি কর্মচারিদের বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরা, উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহনের আগে প্রকল্প এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ খেয়াল করা, দেশের প্রতিইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনা, কৃষিজমি রক্ষায় যত্রতত্র শিল্প স্থাপন করতে না দেওয়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করাসহ আরো অনেক কথা। সব শেষে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য রাত ১০টার পর হাট,বাজার,দোকান পাট সব কিছু বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি আঁচ করতে পেরেছেন ইউক্রেন-রাশিয়ার এই সর্বগ্রাসী যুদ্ধের শেষ পরিনিতি কি হতে পারে। এই যুদ্ধের গোলাগুলি কোন এক সময় হয়তো থেমে যাবে। কিন্তু এর রেস কাটবে না। কারণ যুদ্ধ শুধু রনাঙ্গনেই নয়, সর্বত্রই শুরু হয়েছে। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা,আমদানি-রপ্তানি বানিজ্যে নয়া মেরুকরণসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটাবে। সেরকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করে টিকে থাকার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা। কেননা দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, স্বপ্ন থাকবে। কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে ? যে যারমত করে হিসেবের অংক কষতে শুরু করেছে। দোকান পাট বন্ধের ঘোষনা ৮টার বদলে ১০টায় গেছে। ব্যবসায়ীরা সবকিছুতে সাবসিডি চাচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বহু নজির আছে, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় একশ্রেণীর লোক বেসুমার অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যায়। আর্ন্তজাতিক লুটেরা চক্রের ওই লুটের সম্পদ রক্ষার নিরাপদ রক্ষক ‘সুইস ব্যাংক’। ওই ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমানো টাকার পরিমান ৮ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৮ লাখ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরেই জমা হয়েছে ২ হাজার ৯৯২ কোটি ডলারের অধিক টাকা। এ হিসাব শুধু নগদে জমানো টাকার। এর বাইরে সোন-দানা, হীরা, মনি-মুক্তার হিসাব আলাদা। গত দুই বছর দেশ করোনায় আক্রান্ত। ব্যবসা-বানিজ্য জীবন-জীবিকা সব কিছু প্রায় অচল ছিল। তারপরও এত বিপুল পরিমান টাকা সুইস ব্যাংকে গেল কেমনে। কারা, কোথা থেকে কিভাবে এত টাকা পাচার করলো এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। মোটা দাগে এর জবাব হচ্ছে ব্যাংক ও বাজার লুট করে এই বিপুল পরিমান অর্থ পাচার করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর মারপ্যাচের বাজেটে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডে আঘাত করার কালো হাতগুলো ভেঙ্গে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাবনা নেই। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী চাইলে কি হবে। তাঁর চার পাশের অনেকেই কমবেশি বেনিফিসিয়ারি। তারাই সব কিছু করে।
শেখ হাসিনা সংসদ নেতা, সরকারের প্রধান নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রী। তাই দেশের সব কিছু তাঁকেই দেখতে হয়। নিজ দলের লোকদের সামলোনো থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের সকল চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সবই সামলানোর দায় যেন তাঁর একার।এটা কি করে সম্ভব। একজন মানুষ সারাক্ষণ সবাইকে কেমনে পাহাড়া দিয়ে রাখবেন। তিনি কত দিক সামলাবেন। বাজেটের খসড়া নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী করেননি। করেছেন মন্ত্রী আমলারা। তারাই ঠিক করেছেন কোথা থেকে টাকা পাবেন, কোথায় কিভাবে খরচ করবেন। তারাই প্রধানমন্ত্রীকে দিশা দিয়েছেন, কি করলে আগামী নির্বাচনে নৌকা খাল-বিল, নদী-নালা সাগর-মহাসাগর পাড়িয়ে দিয়ে হুরহুর করে মহাকাশে পৌঁছে যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়েছে, করোনা’র ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে মানুষের জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে এবারের বাজেট বানানো হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশবাসীর একটু সুখ শান্তির জন্য নিরন্তর লড়াই করা একজন মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাবিকভাবেই এধরণের পরিকল্পনার কথা শুনলে কিছুটা হলেও হাঁফ ছেড়ে নিশ্বাস নিবেন। ভিতরে কি আছে সেটার বিশ্লেষন পরে করা যাবে।
টাকার সন্ধানে অর্থমন্ত্রী
অর্থমন্ত্রী আগে থেকেই বড় ব্যবসায়ী। অনেকে বলে টাকার জোরে তিনি রাজনীতিবিদ হয়েছেন। ব্যবসায়ী বলেই তিনি জানেন, কোথায় ব্যবসা আছে। বাজেটের ঘাটতি পূরণের পন্থা খোঁজতে তিনি ব্যাংক এবং ডাকঘরে রাখা সাধারণ মানুষের সঞ্চয়পত্রের সন্ধান পেয়েছেন। আরেকটি উৎস হয়তো তার নজর এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে ‘মাটির’ ব্যাংক। বাংলাদেশে মানুষের ঘরে ঘরে ‘মাটির ব্যাংক’ আছে। সেখানেও অনেকে টাকা পয়সা জমায়। অর্থমন্ত্রী সেখানেও নজর দিতে পারেন! সেখান থেকেও তিনি বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য হয়তো অনেক টাকা পাবেন। আগে গ্রামাঞ্চলে প্রচলন ছিল, প্রত্যেক বাড়িতে দাদি,নানি,মা-খালারা ঘরে ঘরে ‘মুষ্টির চাল’ রাখতো। এখন অবশ্য সেটা নেই বললেই চলে। থাকলে অর্থমন্ত্রী ‘মুষ্টির চাল’ থেকেও আয়কর সংগ্রহ করতে পারতেন!
ডাকঘর সঞ্চয়
দেশের নিন্ম আয়ের মানুষ বিভিন্ন ব্যাংক বা ডাকঘরে সঞ্চয়ের টাকা রাখে। পরবর্তীতে এতে যুক্ত হয় নিন্ম মধ্য ও মধ্যবিত্তের মানুষ। তারাও ব্যাংক এবং ডাকঘরে শেষ জীবনের সহায় মনে করে কিছু কিছু করে টাকা পয়সা জমিয়ে রাখতো। ব্যাংকগুলোতে আগে ডিপিএস করা করা হতো, এখন সে ব্যবস্থা নেই। এখন হয় এফডিআর। এই এফডিআরে আগে লাখে প্রায় হাজার টাকা করে মাসে মুনাফা পাওয়া যেতো। বহু নিন্ম ও নিন্ম মধ্য ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার লোক এফডিআর বা ডাকঘর সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দিয়ে সংসার চালিয়ে নিতো। এখন আর পারেনা। দিনকে দিন নিয়ম পাল্টাচ্ছে। এখন সঞ্চয়ের মুফার পরিমান নীচে নামতে নামতে তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। নানা রকমের ট্যাক্স ও সার্ভিস চার্জ কেটে নেওয়ার পর সাকুল্যে ৫/৬ পার্সেন্টে নেমেছে। আগামীতে হয়তো মুনাফা দূরে থাক, এফডিআর বা সঞ্চয়পত্রে টাকার রাখার জন্য উল্টো ব্যাংক এবং সরকারকেই প্রতিমাসে টাকা দিতে হবে। এখনই একদিকে সঞ্চয়ের মুনাফা কমছে অপরদিকে বিভিন্ন উছিলায় ট্যাক্স বাড়ছে।
পাচার করা টাকা
বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, লুটেরাদের নাকি জাতে তোলার জন্য ৭% পার্সেন্ট ট্যাক্স দিয়ে বিদেশে পারাকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরৎ আনার নামে আরো পাচারের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে! কারা করছে ? আগেই বলেছি, যারা সরকার বানায় সরকার ফালায় তারা। তারাই বাজেট বানিয়েছে। জাতীয় সংসদে সেই বাজেট নিয়ে আলোচনা চলছে। সময় থাকলে টেলিভিশনে বাজেট আলোচনা শুনতে পারেন। একটি দলের লোক সরব থাকে রাজনীতির বদলে ইতিহাসের বিরোধীতা নিয়ে। তারা আর কিছু বুঝে বলে মনে হয়না। অন্যরা যখন যেদিকে বাতাস বয়, সেদিকে কথা কয়। বাজেটে সাধারণ মানুষের কথা বলার লোক নেই। মোদ্দা কথা যারা উচ্চ স্বরে কথা কয়, লুটপাটের জন্য সরকারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দমক দেয় তাদের খাত থেকে টাকার অংকে কত টাকা পাওয়ার টার্গেট সেটার সহজে বোধগম্য কোন উল্লেখ নেই। কারণ যিনি বাজেট বানিয়েছেন তিনি নিজে এবং তার আশ-পাশের সবাই বড় মাপের বেনিফিসিয়ারি। তারা জানেন কাদের গলা কেটে সহজে টাকা তুলে নেওয়া যাবে। অথচ কোন শব্দ হবেনা।
ঘাটতি ছাড়া বাজেট নাই
মুখে যে যা-ই বলুক এযাবৎকালে এদেশের একটি বাজেটও ঘাটতি ছাড়া হয়নি। কোন অর্থ বছরেই বৈদিশেক সহায়তার আংখিত টাকা পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি ধণী লোকদের কাছ থেকে কোন সরকারই সঠিক ট্যাক্স আদায় করতে পারেনি। কারণ ওখানে শেয়ারের কারবার আছে। যারা হিসাব কষে, হিসাব রাখে, হিসাব দেখায় তারাই শেয়ার কারবারি-বেনিফিসিয়ারি। দেশের সাধারণ মানুষ অর্থনীতির পন্ডিত নয়। তারা জরিপের মার-প্যাচ খুব একটা বুঝে না। মোটা দাগে বুঝে, নিন্ম ও নিন্ম মধ্য শ্রেণীর মানুষের সম্বল ‘সঞ্চয়’ লুট না করলেও বাজেট চলবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, বাড়তেই থাকবে। সময়ে সময়ে মুনাফাখোর শ্রেণী ১০ টাকা বাড়িয়ে ২ টাকা কমিয়ে বলবে, ‘সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে’ ব্যবসায়ী সমাজ জিনিসপত্রের দাম কমিয়েছে।
কৃষির গুরুত্ব
বাজেটের ঘাটতি পূরণের নামে নিন্ম ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সম্বল লুট না করে কৃষির দিকে নজর দেওয়ার কোন বিকল্প নেই। কৃষি খাতের উৎপাদন দ্বিগুন-তিনগুন বাড়ানোর বাজেট বানান। তাতে দেশের বিপুল সংখ্যক যুব সমাজ কৃষি কাজের দিকে মনোযোগি হবে। কৃষি উপকরন বীজ, সার, কীটনাশকসহ সবকিছু আরো সহজলভ্য করতে পারলে শিল্পের জন্য সহায়ক হবে। শিল্পের নামে ব্যাংক লুটের পথ আটকান। টাঙ্গাইল,ময়মনসিংহ গাজীপুরে কি হচ্ছে দেখুন। ময়মনসিংহের ভালুকা, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, টাংগাইলে ঘাটাইল, মধুপুর, সখিপুর, বিস্তির্ণ গাজীপুর আদিভূমির ভূখন্ড। এসব এলাকায় বহুতল ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে তেমন কোন ব্যায় হয়না। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল। ফলে এ অঞ্চলের কৃষি জমি বেসুমার লুট হচ্ছে। দক্ষিন-পশ্চিম উত্তর ভালুকার হবিরবাড়ি, পাড়াগাও, কাচিনা, বাটজোর, ডাকাতিয়া, আঙ্গারগারা, মল্লিকবাড়ি, কাতরামারি, ভরাডুবা, মেদুয়ারি, উথুরা, বনগাঁও, চামিয়াদিসহ ফুলবাড়িয়ার আছিম, পোড়াবাড়ি, খলাবাড়ি,খাগাডি,জামতলি,শাপখালি বগারবাজার এলাকার সবখানেই বাউন্ডারি শিল্প। এসব এলাকার উর্বর কৃষিজমি বাউন্ডারি দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এ অবস্থা শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলেই নয়, গোটা বাংলাদেশেই দেখা যাবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কৃষিজমিতে শিল্প স্থাপন করলে গ্যাস-বিদ্যুত দেওয়া হবে না। তিনি শিল্প বিরোধী নন। তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তাতে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান বাড়বে। পদ্মা সেতুর উদ্ভোধনকালেও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু তাঁর এই সময়োচীত দুরদর্শী ঘোষনা বাস্তবানয় হবে কেমনে। কথায় বলে, ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী’। জনকল্যানে শুধু সরকার নয়, জনপ্রতিনিধিরাও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারেন। কারন, জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই গণতান্ত্রিক সরকার হয়। বাজেট অধিবেশনে জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিন্ম,ন্মিম মধ্য ও মধ্য বিত্তের মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে। আগামী অর্থ বছরের বাজেট উৎপাদন ও কর্মসংস্থান উপযোগী সাধারণ মানুষের বাজেট হলে তার প্রতিফলন জাতীয় নির্বাচনে পাওয়া যাবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে।