Search
Close this search box.

কূটনীতির সুফল মিলবে কবে?

মানসিক ‘গণধর্ষণ’

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সেনা শাসিত মিয়ানমার শুধু লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ পাঠিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, এখন যুদ্ধেরও উসকানি দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। সেই দেশ থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল বাংলাদেশ সীমান্তে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে এসে পড়েছে ২৮ আগস্ট ২০২২। তবে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি। হতাহতের ঘটনাও ঘটেনি।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদস্যরা মর্টার শেল দুটি ঘিরে রেখেছেন। এগুলো নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চলছে। স্বাবাবিকভাবেই ঘটনার পর নো ম্যান্স ল্যান্ডে বসবাসরত রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হয় সেনা শাসিত মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে, হত্যা করে দেশ ছাড়া করলেও পুরোপুরি স্বস্তিতে নেই।

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। সীমান্তে মাঝে মাঝেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান চক্কর দিতে দেখা যায়।

লাখ লাখ রোহিঙ্গা হত্যা করা, নির্যাতন করা, দেশ ছাড়তে বাধ্য করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া এবং সর্বশেষ এই মর্টার নিক্ষেপ, সবগুলো ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষ সরকারের দিক থেকে কড়া জবাব চায়।

সেখানে এমনই এক শাসন ব্যবস্থা যে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেত্রী অং সান সুচি, রোহিঙ্গাদের প্রতি যে বর্বরতা হয়েছে তাকে সমর্থন করেও, সেনা শাসকের কবল থেকে মুক্তি পায়নি। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে এখন আবার গৃহবন্দি করা হয়েছে।

অনাদিকাল ধরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে মিয়ানমার। বলতে গেলে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে দেশটির সেনা শাসকেরা। কারণ পাশে আছে শক্তিশালী চীন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘে মিয়ানমারকে বারবার সমর্থন করেছে চীন। বেইজিংকে মিয়ানমারের প্রধান ত্রাতা হিসেবে দেখে পুরো বিশ্ব।

পাশে আছে শক্তিশালী চীন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘে মিয়ানমারকে বারবার সমর্থন করেছে চীন। বেইজিংকে মিয়ানমারের প্রধান ত্রাতা হিসেবে দেখে পুরো বিশ্ব।

 

কূটনীতির সুফল মিলবে কবে?

মিয়ানমারের সাথে বিশাল বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়াও তার আধুনিক সব অস্ত্রের উৎস হিসেবে দেখা হয় বেইজিংকে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট বলছে, মিয়ানমারের ৬৮ ভাগ অস্ত্রের আমদানি হয় চীন থেকে। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, রাডার, ড্রোনসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে এসবের মধ্যে।

মিয়ানমার থেকে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে, তার পাঁচ পূর্ণ হলো ২৫ আগস্ট। ঠিক যখন বিতাড়িত রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করে সেই সময় আমি বলেছিলাম, ‘আজ এবং আগামীর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ও সমস্যা হবে এই রোহিঙ্গারা’।

তবে কীসের আশায় বা কোন বিভ্রমে এদের আটকানো হয়নি, কেন সদর দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল তা আজও অজানা। কক্সবাজারের বিরাট অঞ্চল জুড়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। জেলার জীববৈচিত্র্য একদম বিনাশ হয়ে গেছে।

দাতা গোষ্ঠী শুধু রোহিঙ্গাদের খাওয়া দাওয়ায় সহযোগিতা করছে, কিন্তু আমাদের জলবায়ু ও পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ল, বিশ্ব সেই ব্যাপারে একদম উদাসীন।

কক্সবাজার জেলার ডেমোগ্রাফিতেও বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এখন আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারাই সেখানে সংখ্যাগুরু। এর বাইরে যে সমস্যা স্থানীয়দের মোকাবিলা করতে হচ্ছে তা হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গার স্রোত নামার পর যত দিন যাচ্ছে ততই আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

ক্যাম্পের বাইরেও রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করছে। এর পাশাপাশি এসব গ্রুপ ইয়াবা ও আইসের মতো মাদক ও অস্ত্রের পাচার, ব্যবসা, চোরাচালান ও রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে যৌন ব্যবসাও করছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সমাধানের কোনো পথ দৃশ্যমান নয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেওয়া হবে।

ক্যাম্পের বাইরেও রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করছে। এর পাশাপাশি এসব গ্রুপ ইয়াবা ও আইসের মতো মাদক ও অস্ত্রের পাচার, ব্যবসা, চোরাচালান ও রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে যৌন ব্যবসাও করছে।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন অভিযানের পাঁচ বছর পূর্তিতে দেওয়া বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এই কথা বলেছেন। তবে কবে থেকে কত সংখ্যক রোহিঙ্গা যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হবে, সেই বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

আচরণে বোঝা যায়, মিয়ানমার সরকার আলোচনায় বসতে রাজি নয়। বরং উল্টো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সীমান্ত অস্থির করার চেষ্টায় রত। তাই বাংলাদেশের সামনে একমাত্র উপায় এখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেকোনো উদ্যোগে চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারসহ এই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চায় এবং এতে করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে।

চীনের এই ফাঁদ থেকে বের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশকে। কারণ রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেনি, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং বাংলাদেশ এই সমস্যার সবচেয়ে বড় ভিকটিম।

সময় অনেক চলে গেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালোভাবে চেপে ধরতে হবে মিয়ানমারকে। ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরে খ্রিস্টানদের ওপর জুলুমের কারণে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়া হস্তক্ষেপ করে এবং পূর্ব তিমুরকে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র বানিয়ে দেয়।

সুদানের দক্ষিণ অঞ্চলে খ্রিস্টানদের ওপর যখন অবিচার ও জুলুমের অভিযোগ ওঠে, তখন পশ্চিমা দুনিয়া দক্ষিণ সুদানকে মূল সুদান থেকে আলাদা করে খ্রিস্টানদের জন্য স্বাধীন দক্ষিণ সুদানের জন্ম দেয়।

বিশ্বকে এমন করে ভাবতে হবে এই রোহিঙ্গাদের নিয়েও। বিশ্ব সম্প্রদায় শুধু বাংলাদেশকে চাপে রাখবে, সেটা হতে পারে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা আরও দৃশ্যমান করতে হবে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা – প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ