রাজন ভট্টাচার্য
নিরাপদ সড়ক নিয়ে যখন এত কথা, আলোচনা চলছে তখনও দুর্ঘটনা থেমে নেই। প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে রাস্তার প্রাণনাশ ও পঙ্গুত্বের খবর। স্বজনহারা পরিবারগুলোর নিঃস্ব হওয়ার সংবাদ। সরকারি বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক একটি পরিসংখ্যানও বলছে না, দেশে সড়ক নিরাপদ হয়েছে বা দুর্ঘটনা হ্রাস পাচ্ছে।
তবে কি এই সড়ক দুর্যোগ থেকে আমাদের মুক্তি নেই? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকারের আন্তরিকতা ও কার্যক্রম কতটুকু। যদিও এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
ত্রিশালে দুর্ঘটনায় মায়ের পেট ফেটে শিশু জন্মগ্রহণের রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৪ জুলাই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবিসহ সড়ক দুর্ঘটনার একটি ভয়াবহ মর্মান্তিক খবর ছবি সহ প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ট্রাক চাপায় রাস্তায় সন্তানের ছিন্ন ভিন্ন নিথর দেহ পড়ে আছে। পাশে বসে আহাজারি করছেন বাবা। দুর্ঘটনায় মেয়েটির মাথা ও মুখমণ্ডল থেতলে গেছে। ছবিটি এতই বিভৎস যে, কাপড় দিয়ে শেষ পর্যন্ত মেয়েটির শরীরের অর্ধেক অংশ ঢেকে দিতে হয়েছে।
এই দৃশ্য দেখে কোনও বাবা কি স্বাভাবিক থাকতে পারেন? থাকা সম্ভবও নয়। দুর্ঘটনার পর বাবা গাড়ির নিচে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন। তাকে পথচারীরা রক্ষা করেছেন। কেন বাবা ফারুক এরকম করলেন? যার গেছে তিনিই বোঝেন কী হারিয়েছেন।
দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের দেখা সব স্বপ্নই মাটির সঙ্গে মিশে গেলো। ফাতেহা জাহান জেবা (১৮) আর কখনও বাবা বলে ডাকবে না। কখনই তার বড় হওয়ার স্বপ্নের কথা জানাবে না। কখনও হাসিমুখে বাবাকে এসে জড়িয়ে ধরবে না। বাবা ঘরে ফিরতে দেরি হলে দুঃশ্চিন্তায় পায়াচারি করে রাত জাগবে না, বারবার ফোন দেবে না। একটি দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ঘরের আলোটাই নিভে গেছে ফারুক দম্পতির।
সবচেয়ে কষ্টের কথা হলো, মেয়েটি তো একটু আগেও মোটরসাইকেলের পেছনে বসে বাবার সঙ্গে গল্প করতে করতে যাচ্ছিল। মুহূর্তের মধ্যে এতবড় সর্বনাশ ফারুকের জন্য অপেক্ষা করছে কে জানতো?
তাই বাবা এই মর্মান্তিক মৃত্যু কীভাবে মেনে নেবেন? কোনোভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না। হয়তো ফারুক দম্পত্তি শোক কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবেন। কিন্তু সন্তান হারানোর যন্ত্রণা তো আমৃত্যু তাদের বয়ে বেড়াতে হবে। যতবার ঘরে জেবার ছবির দিকে
চোখ যাবে, ততবার জলে বুক ভিজবে। হাহাকার করে ওঠবে বুক। কথায় আছে– সন্তান আর অর্থের শোক কখনও ভোলা যায় না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত ২৩ জুলাই চট্টগ্রামে লরির ধাক্কায় বাবার মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে কলেজছাত্রীর ফাতেহা জাহান জেবার মৃত্যু হয়। সীতাকুণ্ডে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোডের ৩ নম্বর ব্রিজের পাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে। জেবা নগরীর এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
চোখের সামনে মেয়ের এমন করুণ মৃত্যু কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না ফারুকের। ঘটনার পর সড়কের ওপর উদ্ভ্রান্তের মতো কান্নাকাটি ও ছোটাছুটি করতে থাকেন। মেয়েকে মোটরসাইকেলে করে কলেজে পৌঁছে দিতে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি।
পথে একটি লরি মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। ছিটকে পড়ে যান জেবা। তখন লরিটি তাকে পিষ্ট করে চলে যায়। রাস্তায় নিথর পড়ে থাকা মেয়ের কাছে একবার ছুটে যান তো আরেকবার চলন্ত গাড়ির নিচে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেন ফারুক। তার আহাজারিতে উপস্থিত কেউ চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি।
এতবড় একটি ঘটনার পর লরি চালক নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেলো! হয়তো সেও ধরা পড়বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। কিন্তু মানুষ এত অমানবিক কীভাবে হয়? এত পাষাণ হৃদয় হতে পারে? চালক তো দেখেছে এতবড় একটি ঘটনা ঘটেছে। তার গাড়ির চাকার নিচে মানুষের প্রাণ গেলো। সে নিজের জীবন নিয়ে পালালো। একজনকে হত্যা করে আরেকজন কি কখনও ভালো থাকতে পারে?
এই ঘটনাটি যদি এই লরি চালকের ক্ষেত্রে হতো? তবে তিনি কি স্বাভাবিক থাকতে পারতেন। তিনিও নিশ্চয়ই পালিয়ে যাওয়া চালকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। দেশে এরকম একটি নজির নেই, সড়ক দুর্ঘটনার পর চালক নিজেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে বলেছেন– ‘আমিই সেই হত্যাকারী’। যদিও এরকম নজির না থাকার পেছনে নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার ভয়সহ নানা কারণ রয়েছে।
ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় রাস্তায় পেট ফেটে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে সে তো কোনোদিন ‘মা’ বলে ডাকতে পারবে না। মাও তো বুকের ধনকে একবার দেখে যেতে পারেননি। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় ঘাতক ট্রাক একসঙ্গে বাবা-মাকে কেড়ে নিয়েছে। দুর্ঘটনায় শিশুটির হাতের আঙুল, ঘাড়ের হাঁড় ভেঙেছে। পরিবারে অভাব থাকায় আরো দুই বোনদের সঙ্গে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুটির দেখা হবে কিনা? কেউ জানে না। এরকম ভয়াবহ দুর্ঘটনা কয়টি দেশে হয়? জানা নেই।
তেমনই ফাতেহার পরিবারে সন্তান হারানোর মাতম থেমে যাওয়ার নয়। অথচ চালকদের মনে এসব বিষয় কখনও কষ্টের রেখাপাত সৃষ্টি করে না।
এরপরেও কারো যেন টনক নড়ে না। সবাই যেন এক ধরনের নির্বিকার অবস্থায় আছি। দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ অনেক কম, একথা সরকার কখনই স্বীকার করতে নারাজ। তেমনই রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএ-এর হুঙ্কার দেওয়া ছাড়া আর কী করার আছে।
সব কিছুর পরেও বাস্তবতা হলো হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই। দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত দৃশ্যমান কাজ শুরু করা উচিত। নিয়ম অনুসরণ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিশ্চিত করার পাশাপাশি চালকদের মানবিক বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। তাহলে তারা আরও সচেতন হবে। দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু হলে সেই পরিবারে কী ধরনের অমানিশা নেমে আসতে পারে? তা কোনও চালকই ভাবেন না।
গাড়ি চালানোর সময় তাদের মনে এরকম বিষয় কখনও কাজ না করার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সবকিছুর দাম বাড়ার দিনে সংসার চালানো, গাড়ি মালিকের টাকা পরিশোধ সহ নানা প্রতিযোগিতার মুখে তাকেও টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এসব কিছুর মধ্যে চালকের ভিন্ন চিন্তা করার সুযোগ হয়তো থাকে না।
তাছাড়া দুর্ঘটনার পর চালকরা যুগের পর যুগ গুরু পাপে লঘুদণ্ড দেখে অভ্যস্ত। শত অন্যায় আর নৈরাজ্যের পরও গাড়ির চাকা ঘুরবে, দুর্ঘটনা ঘটবে, মানুষের মৃত্যু হবে তারপর জামিনে তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে মুক্তি মিলবে। তাই পুরো বিষয়গুলো চালকরা হয়তো স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখেন। মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের দাবির প্রেক্ষিতে সড়ক আইনেই কার্যকর করা যাচ্ছে না। শাস্তির সব ধারা দাবির মুখে সরকার সংস্কারের নামে সময় ক্ষেপন করছে। তাহলে প্রকৃত শক্তিশালী কারা?
সময় এখন সড়ক দুর্যোগের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারির অবস্থান থেকে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটানো। তাই সড়ক আইন প্রয়োগ করে দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। গণপরিবহন সেক্টরকে প্রভাবশালীদের ছায়ামুক্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার সম্ভব না হলে চালকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে না। মালিকরাও যেন অপরাধের দায়মুক্তি না পায়। অন্যথায় আমরা জেবার মতো দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া অসখ্য পরিবারগুলোকে কী জবাব দেব?
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক