রাজন ভট্টাচার্য
সরকারি একজন কর্মকর্তা গত ২৩ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘পার্কে আসতে কোনো বাধা নেই তবে স্কুল, কলেজ ফাঁকি দিয়ে নয়। স্কুল, কলেজ ফাঁকি দিয়ে পার্কে আসা ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের নিকট তাৎক্ষণিক মোবাইল ফোনে অভিযোগ করা হয়। সিটি করপোরেশনের এজাতীয় অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ স্ট্যাটাসের সঙ্গে তিনি পাঁচটি ছবিও দেন। ছবিতে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাক পরা ছেলে-মেয়েদের দেখা গেছে। সরকারি এই কর্মকর্তা বিচক্ষণতার সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করেননি। কিছুক্ষণ পর ছবিতে সবার মুখ ঢেকে দেওয়া হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাকে ছেলে-মেয়েরা বাইরে গিয়ে দিনভর সময় কাটাবে! পার্কে বসে প্রেম করবে, রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করবে, মাদক সেবন করবে, এমনকি অসামাজিক কাজকর্ম করতেও দ্বিধা করবে না! এর চেয়ে কষ্টের, লজ্জার আর কী হতে পারে। যদিও এটি কলুষিত সমাজের চিত্র! তাই দায় এড়ানোর সুযোগ কারও নেই। অভিযানের সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। দেখে মনে হয়েছে তারা কৃতকর্মের জন্য কিছুটা হলেও অনুতপ্ত ও লজ্জিত বা অপমানিত। জানি না তারা আবারো এ পথে পা বাড়াবে কি না? কয়েকজনকে দেখে মনে হয়েছে, তারা বিষয়টিকে মোটেই আমলে নেয়নি। তাদের জন্য এটি একেবারেই মামুলিক বিষয়। হয়তো অভ্যাসের কারণে তারা আবারো পার্কে আসবে। দিনভর গল্প আর আড্ডায় মেতে ছুটির সময় বাড়ি ফিরবে!
এ ধরনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের ইতিবাচক অনেক দিক রয়েছে। এই দৃশ্য যেমন অভিভাবকদের চোখ খুলে দিতে পারে, তেমনি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সব পক্ষই সন্তানদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বোচ্চ সতর্ক হয়ে করণীয় ঠিক করতে পারে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিচ্ছে কি না? তা সঠিকভাবে দেখভালের দায়িত্ব শিক্ষকদের কম নয়। এই ছবিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শিক্ষকরা কোনো ভাবেই এমন বাস্তবতার দায় এড়াতে পারেন না।
অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না এসে সরাসরি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে চলে যায় তাহলে প্রতিষ্ঠানের কিছু করার আছে? অবশ্যই করণীয় রয়েছে। তা হলো, অভিভাবকদের নোটিশ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না আসার বিষয়টি নজরে আনা। সমাধান না হলে প্রতিষ্ঠানের নিয়মে শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কথায় আছে সঙ্গ দোষে সঙ্গী নষ্ট। যারা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়ে বাইরে ঘোরাফেরা করে তাদের সঙ্গী বাড়াতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। ধীরে ধীরে তার বন্ধু বাড়বে, কলেবড় বাড়া মানেই সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু অভিভাবকরা তো নির্দ্বিধায় বাড়ি থেকে সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠাচ্ছেন। অথচ সন্তান কোথায় যাচ্ছে? কার সঙ্গে মেলামেশা করছে এ খবর রাখছেন না! তা হয় না।
কথা হলো এরকম বাস্তবতা দেশে কী নতুন? দুই দশক ধরেই বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এরকম দৃশ্য চোখে পড়ছে। সময়ের কারণে ধীরে ধীরে তা বেড়েছে। এখন আরও দৃশ্যমান। চোখ কান খোলা রেখে পথ চললেই এরকম চিত্র পথে-ঘাটে অহরহ দেখা যায়। শুধু তাই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় সিগারেট ফুঁকতেও দেখা যায় অল্প বয়সী শিশুদের। অথচ একজন দোকানদার ক্রেতার বয়সের কথা বিবেচনায় না নিয়ে টাকার বিনিময়ে তার হাতে পণ্য তুলে দিচ্ছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সমাজের প্রতি দোকানির কোনো দায়বদ্ধতা নেই? নাকি দায়বদ্ধতা সম্পর্কে তিনি সচেতন নন। এ নিয়ে ভাবনার মনে হয় যথেষ্ট সময় এসেছে। বিষয়টি এমন হতে পারতো না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাকে আসা কারও হাতে নেশাজাতীয় পণ্য বিক্রি করা যাবে না। এমনকি ১৮ বছরের কম কারও হাতে নেশাজাতীয় কোনো কিছু কেউ বিক্রি করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই প্রস্তাবটি কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেবে কি না জানি না।
চিন্তা করা যায়- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাকে ছেলে-মেয়েরা বাইরে গিয়ে দিনভর সময় কাটাবে! পার্কে বসে প্রেম করবে, রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করবে, নেশা খাবে, এমনিক অসামাজিক কাজকর্ম করতেও দ্বিধা করবে না! এর চেয়ে কষ্টের, লজ্জার আর কী হতে পারে। যদিও এটি কলুষিত সমাজের চিত্র! তাই দায় এড়ানোর সুযোগ কারও নেই। অর্থাৎ পরিবার, সমাজও এ পরিস্থিতির জন্য কম দায়ী নয়। কষ্টের বিষয় হলো সারাদেশে এ ধরনের সমস্যা প্রকট হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? এ নিয়ে কারও খুব একটা মাথা ব্যথা দেখা যায় না। শিশুদের বিপথে যাওয়া মানেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুনাগরিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা। প্রতিরোধ না করলে এ ধরনের সমস্যা সমাজকে আরও নষ্টের দিকে ঠেলে দেবে। নতুন প্রজন্ম মন্দ কাজে আগ্রহী হয়ে দিন দিন আরও বেশি অন্ধকার জগতে নির্দ্বিধায় পা বাড়বে, যা কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। তেমনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
এমনিতেই দেশের শিশুরা ভালো আছে একথা বলার সুযোগ নেই। অবাধ তথ্য প্রবাহের কারণে শিশুদের একটি বড় অংশ ইন্টারনেটে আসক্ত। সারাদিন তারা মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে থাকে, মেতে ওঠে গেম খেলায়। পর্নোগ্রাফি সাইডগুলোতে চষে বেড়ানোর কারণে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। তবুও এসব সাইড বন্ধ করা যায়নি। তেমনি নেশাগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হাড়ে বাড়ছে, হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। টেলিভিশনের পর্দা থেকে শিশুদের চোখ সরে না। অপরাধ বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে শিশুরা ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর খারাপ কাজে নিজেদের জড়াচ্ছে। স্ক্রিন আসক্তিতে নানা রোগে আক্রান্তের পাশাপাশি একক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ায়সহ স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন আসছে শিশুদের। অনেকেই বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে ঘরে-বাইরে যা ইচ্ছা তাই করছে।
সমাজে শিশু-কিশোরদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ কমছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অতিমাত্রায় বাণিজ্যিককরণ হওয়ায় সেখানেও শিশুদের সুস্থ ধারার বিনোদনের মাধ্যম নেই। বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রেণিভিত্তিক ‘ওয়াসঅ্যাপ’সহ বিভিন্ন গ্রুপ খুলছে, এই গ্রুপে তথ্যের আদান প্রদান করছে বা স্কুল কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করছে। এতে শিশুরা মোবাইল ব্যবহারে বাধ্য। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের প্রতি তাহলে কোনো দায় নেই? জানি না সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা সম্পর্কে অবহিত কি না। প্রয়োজনে একটি উচ্চ পর্যায়ে কমিটি গঠন করে তদন্ত সাপেক্ষে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
এর বাইরে দেশজুড়ে চলছে সাংস্কৃতিক ভয়াবহ আগ্রাসন। সাংস্কৃতিক চর্চার পরিধি ছোট হয়ে আসছে। জেলা-উপজেলায় সাংস্কৃতিক ও বিনোদন সংগঠনগুলো নতুন প্রজন্মকে কোনো ভাবেই আর টানতে পারছে না। এসব সংগঠনের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও কমে আসছে। শুধু শহর নয়, গ্রামেও কমছে খেলার মাঠ। পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা থেকে শুরু করে বিনোদনের সব মাধ্যম হারাতে বসেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত দিক থেকে শুরু করে কোনো কিছুই শিশুদের অনুকূলে নেই। সুস্থ ধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে সময় কাটানোর অভাবে প্রজন্মের বিপথগামিতা বাড়ছে। তাছাড়া অভিভাবকরাও শিশুদের জোর করে শেকদের দিকে যুক্ত রাখতে চেষ্টা কমিয়ে দিয়েছেন।
পাড়া-মহল্লায় এখন গ্যাং কালচার অভিভাবকদের বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আর্থিক প্রলোভনে সৃষ্ট গ্যাং কালচার শিশুদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের যে কোনো অপকর্মে ব্যবহার করছে একশ্রেণির লোভী ও স্বার্থবাদি গোষ্ঠী। শিশুদের দিয়ে খুনের মতো জঘন্য, ঘৃণিত; যা আইনের দৃষ্টি সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ সেটিও করানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলালে এসব ঘটনা সত্যিই বিস্ময়কর বটে। তেমনি লজ্জারও। আমরা তো উন্নত দেশের প্রতিযোগিতার দৌড়ে আছি। এ থেকে পেছনের দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। কিন্তু অন্যান্য দেশ তো শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করেছে বা করার চেষ্টায় কমতি নেই। তাহলে আমরা কেন পেছনে থাকব?
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি সুনাগরিক হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে না পারে তাহলে রাষ্ট্রের যেমন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য কোনো ভাবেই পূরণ হবে না, তেমনি অভিভাবরাও সন্তানকে নিয়ে চিন্তামুক্ত হতে পারবেন না। সন্তান যদি আলোকিত মানুষ না হয় তাহলে বাবা-মায়ের এর থেকে কষ্ট আর কী হতে পারে? এজন্য পরিবার থেকে সন্তানের সুশিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি আরও নিশ্চিত করা জরুরি। সব মিলিয়ে শিশুদের আলোকিত ভবিষ্যতের ভাবনা সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে কারও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।