সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত গেলে একটা প্রশ্ন সবসময় বড় হয়ে ওঠে যে, সফরের মধ্য দিয়ে কী পাওয়া গেল? বিষয়টি এমন যে, হাতে করে তিনি কিছু নিয়ে আসবেন বা দিয়ে আসবেন। বিষয়টি ঠিক এমন না। প্রতিবেশিকে বদলানো যায় না, তাই প্রতিবেশির সাথে সম্পর্ক প্রতিবেশির মতোই মধুরতা, তিক্ততা বা বৈরিতার।
ছিদ্রাণ্বেষী বাঙালি প্রথম বিচলিত হল কেন একজন প্রতিমন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে এসেছে। কিন্তু ভারতীয় প্রটোকলের এমন দৃষ্টান্ত অতীতে আরও বড় রাষ্ট্রনায়কদের সাথেও হয়েছে। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে যে সংবর্ধনা দেয়া হয় সেটাই সরকারি, সেটাই রাষ্ট্রীয়। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক সহযোগিতা এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সৈন্য বাংলাদেশের মাটি থেকে প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে দু’দেশের মধ্যে যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আজও অব্যাহত রয়েছে। এখন প্রয়োজন সম-মর্যাদার ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে আগামীর পথে চলা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে সেখানে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, ভারতীয় তিনবাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করেছে। এবং মোদি-হাসিনা রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। বৈঠক শেষে দুই প্রধানমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন যেখানে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রতিবেশি কূটনীতির রোল মডেল হিসেবে অভিহিত করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে যা হয়, যেকোন সফরে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এবারও সেই বিবৃতিতে যোগাযোগ, বাণিজ্য, পানি বণ্টন এবং সীমান্ত নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনার দিকটিও বাংলাদেশের আগ্রহে বিবৃতিতে রাখা হয়েছে।
কূটনীতি বিষয়টি এমন নয় যে, চাইলাম আর সব পেয়ে গেলাম। বিশেষ করে ভারতের সাথে আমাদের অনেক অমীমাংসিত বিষয় প্রধানমন্ত্রী গত ১৩ বছরের মিটিয়েছেন। কিন্তু কিছু বিষয় বরাবরের মতোই এবারের সফরেও আলোচিত হয়েছে। এগার বছর ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন চায় বাংলাদেশ। এটা দুর্ভাগ্যজনক এ কারণে যে, ১১ বছর আগে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে দুই দেশ সম্মতিতে পৌঁছুলেও ভারতীয় রাজনীতির অভ্যন্তরীণ মারপ্যাঁচে চুক্তি হতে গিয়েও হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তুত থাকার পরও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাগড়া দিয়ে এটি আটকে দিলেন এবং এখন পর্যন্ত সেই জট খুলতে পারেনি ভারতীয় পক্ষ। এই জট খুলতে না পারা ভারতীয় অনীহা কিংবা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা – দুই হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।
দুটি দেশের ভারতের সঙ্গে অভিন্ন ৫৪টি নদী রয়েছে। এই দুই পক্ষই অভিন্ন নদী সমূহের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ভারতের অংশীদার হতে এবং একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। অববাহিকা এলাকার মানুষের কল্যাণের জন্য দুই পক্ষের মানুষেরই যৌথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এবার হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে এবার যে সাতটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে তার একটি হচ্ছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন নিয়ে।
এই চুক্তির অধীনে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কুশিয়ারা থেকে পানি উত্তোলন করতে পারবে বাংলাদেশ। এটি একটি ভাল প্রচেষ্টা সন্দেহ নেই। এর আওতায় বাংলাদেশ সিলেটে কুশিয়ারা নদীর রহিমপুর খাল পয়েন্টে প্রতি সেকেন্ডে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে। বাংলাদেশে চাইছে পাম্প করে উঁচু জায়গাটির অন্য পাশে পানি নিয়ে আসতে। এর ফলে ওই সাতটি উপজেলার ৬,০০০ হেক্টরের মতো জমি সেচের আওতায় আসবে এবং সারা বছর কৃষি কাজ করা সম্ভব হবে।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েও বলতে হবে যে, তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া অনেক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে দুই দেশের সম্পর্কে। বঙ্গবন্ধু কন্যার টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা সবচেয়ে বেশি কাউকে যদি নিশ্চিন্তে রেখে থাকে, তবে তা ভারতের বিস্তীর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ যা করেছে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের দিক থেকে যেভাবে ঝুঁকি মোকাবেলা করেছে সেটা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মূল্যায়ন করে কিনা আমরা জানিনা।
নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আজ যে অগ্রগতি সম্ভবপর হচ্ছে সেই কৃতিত্ব শেখ হাসিনার তথা বাংলাদেশের। সেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভারতকে প্রত্যাশা মতো পাশে পায়নি। রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘকালীন দাবি মায়নমারের উপর সরাসরি চাপ দিক ভারত। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আঞ্চলিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে মায়নমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আসা দশ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় এবং মানবিক সাহায্য দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছে ভারত। এ ব্যাপারে মায়নমার এবং বাংলাদেশ উভয়কেই সহায়তা করার ব্যাপারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতই একমাত্র দেশ যে দুটি দেশেরই প্রতিবেশি। শরণার্থীদের সুস্থ এবং পাকাপাকি ভাবে দ্রুত নিজেদের দেশ ফেরার ব্যাপারে ভারত সহায়তা করবে।’ আসলে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বারতের ভূমিকায় অভিমানী বাংলাদেশ।
আরেকটি বিষয় হলো সীমান্তে হত্যা। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশ নাগরিক হত্যায় সবসময়ই সরব বাংলাদেশের মানুষ। এমনকি যারা ভারতকে নানাভাবে সমর্থন করে তারাও এ বিষয়ে বিব্রত। সীমান্ত হত্যার ঘটনা কমেছে এটা ঠিক, তবে একে শূন্যে নামিয়ে আনা যাচ্ছেনা।
অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান করা যায়, অনেকগুলো করা যায় না। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক ঐতিহাসিক শুধু নয়। তার চেয়েও বেশি কিছু। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা না করলে এ দেশ আমরা পেতাম না। এদেশের মাটিতে রয়েছে ভারতীয় সৈনিকের রক্ত। সে থেকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এক মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক সহযোগিতা এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সৈন্য বাংলাদেশের মাটি থেকে প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে দু’দেশের মধ্যে যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আজও অব্যাহত রয়েছে। এখন প্রয়োজন সম-মর্যাদার ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে আগামীর পথে চলা।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।