Search
Close this search box.

আশা ও আশঙ্কায় দুলছে বিএনপি

আশা ও আশঙ্কায় দুলছে বিএনপি

বিভুরঞ্জন সরকার

বিএনপি বলে আসছে, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে দলটি কোনো নির্বাচনে যাবে না। বিএনপি সরকারের পদত্যাগ, না হলে পতন চায়। বিএনপি লক্ষ্য পূরণের জন্য গত কয়েক মাস ধরে দলীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। সব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে না। কোথাও কোথাও পুলিশ অথবা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে মারামারি হচ্ছে। পুলিশের গুলিতে ভোলাসহ কয়েক জায়গায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।

বিএনপি এর বাইরে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টাও করছে। সরকারবিরোী সব দলকে এক মঞ্চ আনতে না কারলে অন্তত যুৎপথ আন্দোলনের কথাও বলা হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি আছে বলে মনে হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সবাই চায়। তবে যত সুষ্ঠু নির্বাচনই হোক না কেন বেশির ভাগ দলের কোনো নেতারই বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থন ছাড়া জেতা সম্ভব নয়। আন্দোলনের ব্যাপারে একমত হলেও নির্বাচনের বিষয় সামনে এলে ঐক্যের প্রশ্ন নড়বড়ে হয়ে ওঠে। অন্য দলের নেতাদের খামাখা জিতিয়ে আনার আগ্রহ বড় দলের না থাকাই স্বাভাবিক। সামনে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হলে আওয়ামী লীগ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে বিএনপির আশঙ্কা। বিএনপির আশা, যেহেতু সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ক্রমবর্ধমান এবং আমাদের জনমনস্তত্ত্ব টানা কোনো দলের ক্ষমতায় থাকার বিরোধী, সেহেতু এবার তাদের আন্দোলনে সুফল মিললেও মিলতে পারে!

বিএনপির মিত্র দলের নেতাদের একটি তালিকা করলেই বোঝা যায়, তাদের কয়জনের জয়লাভের সম্ভাবনা আছে! আবার ওইসব নেতা এতবেশি ডিগবাজি খেয়ে অভ্যস্ত যে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা একেবারে তলানিতে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার মাহমুদুর রহমান মান্না। মান্না আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেও জিততে পারেননি। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জিতবেন, তার নিশ্চয়তা কি?

ধানের শীষের যে প্রার্থীকে বঞ্চিত করে তাকে মার্কা কর্জ দেওয়া হবে, সেই বঞ্চিতজন কি তাকে জেতানোর চেষ্টা করবেন? বিএনপির পক্ষের আরেক খাম্বা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তিনিও কি নির্বাচনে জেতার মতো জনপ্রিয় ব্যক্তি? বিএনপির কোনো নিশ্চিত আসন তাকে উপহার দিলে যদি তার ভাগ্যে শিঁকে ছেড়ে। এভাবে আরও যত নেতার নামই উল্লেখ করা হোক না কেন, সবাই তো জাতীয় নেতা, নির্বাচনী এলাকা নেই কারো।

এই সব নেতাদের নিয়ে আন্দোলন করা যায়, নির্বাচন করলে কি ভালো ফল পাওয়া যাবে? কেউ কেউ এজন্যই মনে করেন, বিএনপির নির্বাচনে অনাগ্রহ। তবে সরকার মনে করছে, বিএনপি এখন মুখে যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপির উপায় থাকবে না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নানা গড়িমসি করে শেষপর্যন্ত এলোমেলোভাবে অংশ নিয়েছে। এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে বলে সরকারি মহল মনে করছে। সরকারের সঙ্গে বিএনপির একটি অংশ যোগাযোগ করছে বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে।
সরকার মনে করছে, আগের দুটি নির্বাচন যতটা অনায়াসে পার হওয়া গেছে, আগামী নির্বাচন ততটা সহজে পার হওয়া যাবে না। দেশের ভেতরে যেমন চাপ থাকবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের, দেশের বাইরে থেকেও তেমন চাপ থাকবে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব একতরফা সংসদ দেখত চায় না। সেদিক থেকে এবারের সংসদে বিএনপির আসন সংখ্যা বাড়িয়ে একটি সমঝোতা হওয়ার আশা করা হচ্ছে। ১০০ আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে এবং তা কার্যকর হওয়ার বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থার নিশ্চয়তা পেলে মূল বিএনপি কিংবা বিএনপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নির্বাচনে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়াকে বিএনপির কৌশল হিসেবে ধরে নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা মনে করছেন, নির্বাচনের সময় আরও কাছাকাছি এলে বিএনপি হুট করে তাদের কৌশলে পরিবর্তন আনতে পারে।
২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি ‘ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে’ এসেছিল উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন দলের প্রবীণ নেতা মতিয়া চৌধুরী একটি দৈনিককে বলেছেন, নির্বাচনে না হলে হারুনুর রশীদ সংসদে আসল কীভাবে! রুমিন ফারহানা তো তাদের নারী কোটায়। মোটেই নির্বাচন করলাম না, আবার নারী কোটা নিলাম। মুশকিল হলো, তারা পানি খায় ঘোলা করে। রাজনৈতিক অবস্থান যাচাই-বাছাই করার জন্য বিএনপি এখন কর্মসূচি পালন করে চলেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না প্রকাশ্যে বার বার বললেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সরকারের কাছে তথ্য আছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা আসনভিত্তিক কর্মসূচি পালন করে আসছে। এ ছাড়া ভোট ঘনিয়ে এলে তাদের নেতা-কর্মীদের একটা চাপ থাকবেই। শেষ পর্যন্ত তারা ভোটে আসবেই।

২০০৯ সাল থেকে তৃতীয় মেয়াদে টানা ১৩ বছর ক্ষমতাসীন থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। সেই সময় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য দেশজুড়ে আন্দোলনও করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেও একই দাবি করেছিল। বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর তারা দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর ক্ষমতা না থাকায় বিএনপি যেকোনো উপায়ে সংসদ থাকাই উত্তম বিবেচনা করবে।

তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটের আগে ভোট করে ফেলা, গ্রেপ্তার, ভয়ভীতি ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির অভিযোগ করে থাকে বিএনপি। তবে বিএনপিকে এটাও বুঝতে হবে যে দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ দেখার অপেক্ষায় আছেন। তাই আগামী নির্বাচনে কৌশলের খেলা সহজ হবে না। অবশ্য বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে এবার কোনো সংলাপ হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দিয়েছেন। আগের বার সংলাপের অভিজ্ঞতা ভালো নয় বলেই মনে করেন শেখ হাসিনা। আবার নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ৬ অক্টোবর গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন, ‘কে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে আর কে করবে না, আমরা তো কিছু চাপিয়ে দিতে পারি না।…কারণ, এত দিন কাজ করার পরে নিশ্চয়ই আমরা চাইব সবাই আসুক।’ শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেছেন, ‘বিএনপি তো জনগণের কাছে যেতেই ভয় পায়। জনগণের সামনে ভোট চাইতে গিয়েও ভয় পায়।’

আওয়ামী লীগ সভাপতির এই বক্তব্য সম্পর্কে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘উনারা (শেখ হাসিনা) তো চানই বিরোধী দল নির্বাচনে না আসুক। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে উনাদের।’ তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটের আগে ভোট করে ফেলা, গ্রেপ্তার, ভয়ভীতি ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির অভিযোগ করে থাকে বিএনপি। তবে বিএনপিকে এটাও বুঝতে হবে যে দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ দেখার অপেক্ষায় আছেন। তাই আগামী নির্বাচনে কৌশলের খেলা সহজ হবে না।

বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার চেষ্টাকে ‘ফাঁদ’ বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা। সব কিছু বিবেচনায় রেখেই এবার হার্ড লাইনে যাওয়ার চেষ্টা বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। কোনো অবস্থাতেই যেন মাঠ থেকে সরে যেতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে তৎপর রয়েছেন তারা। ছোট-বড় নানা কর্মসূচি পলনের মধ্য দিয়ে নেতা-কর্মীদের প্রস্তুতির পরীক্ষা নিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে শুরু হয়ে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটবে। ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচির ঘোষণা আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে তা নির্ভর করবে কর্মসূচিগুলোতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কেমন হয়, তার ওপর। মানুষের অংশগ্রহণ না বাড়লে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই কোনো ছাড় মিলবে না— এটা ধরে নিয়েই মাঠের ছক সাজাচ্ছে ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। বিএনপি নেতারা এটাও মনে করছেন, নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা নস্যাৎ করতে সরকারের তরফে নানামুখী কৌশল নেওয়া হবে। আবার বিএনপি যদি সহিংসতার পথে হাঁটে তাহলে সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধা হবে । এমনিতেই বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। এমনকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য চাওয়া হচ্ছে।

সামনে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হলে আওয়ামী লীগ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে বিএনপির আশঙ্কা। বিএনপির আশা, যেহেতু সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ক্রমবর্ধমান এবং আমাদের জনমনস্তত্ত্ব টানা কোনো দলের ক্ষমতায় থাকার বিরোধী, সেহেতু এবার তাদের আন্দোলনে সুফল মিললেও মিলতে পারে!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ