Search
Close this search box.

বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে কী শিখলাম আমরা?

বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে কী শিখলাম আমরা?

রেজানুর রহমান

ফোন বাজছে। আমার এক বন্ধু ফোন করেছে। এত সকালে সাধারণত সে ফোন করে না। কোনও কাজ না থাকলে তার সকাল শুরু হয় ১১টার পর। দেশে রাত জেগে কাজ করার একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। অনেকের কাছে গভীর রাতে আড্ডা দেওয়াও একটা কাজ। আজকাল আড্ডা দিতে পাশে মানুষ লাগে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একই নেটওয়ার্কে অনেকের সঙ্গে সহজেই আড্ডা দেওয়া যায়। পাশাপাশি নিমিষেই ঘুরে আসা যায় পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে। রাত জেগে ফেসবুকে পৃথিবী ঘোরার মজা নেন অনেকে। আমার বন্ধুটির যত কাজ রাতে। ওর অফিস জানে ব্যাপারটা। অফিসের কাজে সে বেশ সিরিয়াস। যারা সারা দিন অফিসে থাকে তাদের অনেকের চেয়ে দিনের অর্ধেক সময় অফিস করে শতভাগ দায়িত্ব সম্পন্ন করে সে। এজন্য অফিস কিছু বলে না।

আমার সেই বন্ধু ফোন করেছে। আমি অবাক এবং ভীতও বটে। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলাম– এত সকালে তোর ঘুম ভাঙলো? কোনও দুঃসংবাদ?

বন্ধু আনন্দে বেশ উত্তেজিত। বললো, দুঃসংবাদ নয় একটা সুসংবাদ আছে।

সুসংবাদ, কী?

সাউথ আফ্রিকা তো নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে গেছে। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম– এটা আমাদের জন্য কি করে সুসংবাদ হয়? বুঝিয়ে বল…।

বন্ধু উত্তেজনা কমাতে পারছে না। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি উত্তেজিত কণ্ঠে বললো– তুমি কি আসলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না? আজ বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ক্রিকেট লড়াই। নেদারল্যান্ডের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলার ফলাফলের ওপর নির্ভর করেছিল বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের খেলাটা নিছক একটা খেলা থাকবে কিনা। নেদারল্যান্ড যদি দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারে তাহলে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের খেলাটা নিছক নিয়ম রক্ষার খেলা থাকবে না, সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়েও পরিণত হবে। আনন্দের খবর হলো, দক্ষিণ আফ্রিকা নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে গেছে। কাজেই আমাদের বাংলাদেশের সেমিফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এবার তোমার কাছে বিষয়টা কি পরিষ্কার? নেদারল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার খেলার খবর ইচ্ছে করেই রাখিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে নেদারল্যান্ড পারবে না এটাই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্রিকেট মূলত অনিশ্চয়তার খেলা। মাঠে ভুল করলে বড় দলও ছোট দলের কাছে অসহায়ভাবে হারে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।

ব্যাপক আগ্রহ, উত্তেজনা নিয়ে টিভির সামনে বসলাম। ইতোমধ্যে ফোনে অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। কেউ অফিসে, কেউ বাসায়। কেউ রাস্তায় গাড়িতে যাচ্ছে। সবাই ব্যস্ত ক্রিকেট নিয়ে। আমাদের আনন্দ আলো অফিসে বসেই খেলা দেখবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। সকাল দশটায়ও অনেকেই অফিসে উপস্থিত। একটাই উদ্দেশ্য, দলবেঁধে খেলা দেখবে। খেলা শুরু হলো। টসে জিতেছে বাংলাদেশ। ব্যাটিংয়ে নামলো। শুরুটা বেশ হলো। আশার পারদ বাড়তে থাকলো। কিন্তু হঠাৎ হলো ছন্দপতন। একের পর এক উইকেটের পতন হচ্ছে। ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসান শূন্য রানে আউট হলেন। যদিও তার আউট হওয়া নিয়ে চরম আপত্তি আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। মাঠ ছেড়ে যাওয়ার আগে সাকিব অসহায়ভাবে দুই আম্পায়ারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেও সঠিক সিদ্ধান্ত পেতে ব্যর্থ হলেন। ভারতের সঙ্গে আগের খেলায়ও বাংলাদেশ আম্পায়ারদের সঠিক সিদ্ধান্ত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিরাট কোহলির ফেক ফিল্ডিং এড়িয়ে গেছেন দুই আম্পায়ার। অথচ ফেক ফিল্ডিংয়ের ব্যাপারে আম্পায়ারদের সঠিক সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে বাংলাদেশ বাড়তি ৫ রান অর্জন করতো। তাহলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলার মোড়ই ঘুরে যেতো। বাংলাদেশ সেই সুযোগ পায়নি। একইভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে খেলায় সাকিবের আউটটিও ছিল বিতর্কিত। সাকিব শূন্য রানে আউট না হলে এই খেলার ফলাফলও হয়তো হতাশার হতো না। অনেক আশার পিরামিড ভেঙে গেলো। খেলায় জয় পরাজয় দুটোই থাকে। কিন্তু লড়াই করে পরাজয়েও আনন্দ আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াইটাও জমাতে পারলো না। বলতে গেলে অসহায় আত্মসমর্পণ করলো পাকিস্তানের সঙ্গে। হেরেই বিশ্বকাপের আসর থেকে বিদায় নিলো বাংলাদেশ। কেন এমন হলো? ক্রিকেটে পাকিস্তান কি বাংলাদেশের থেকে অনেক শক্তিধর দল? ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে খেলতে গেলেই বাংলাদেশ কেন এভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ করে? আমার ক্রিকেটপাগল বন্ধুটির মন খারাপ। ফোন কলে বললো, সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর বাংলাদেশের খেলা দেখবো না। তুমি তো সাংবাদিক। লেখালেখি করো। আমার একটা কথা লিখতে পারবে? কথাটা খুবই সহজ! বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? বিশ্বকাপের মঞ্চে তরুণদের একটা টিম পাঠিয়ে বলা হলো, আমরা তো জেতার জন্য দল পাঠাইনি। শেখার জন্য পাঠিয়েছি। বিশ্বকাপের মতো বড় আসর কি শুধুই শেখার জন্য? নাকি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের মঞ্চ? শেষে একটা কথা বলি– আর কিছু না হোক বাংলাদেশ ক্রিকেট দল শুধু ভারত আর পাকিস্তানকে হারাতে শিখুক। তাহলে পৃথিবীর আর কোনও শক্তিধর ক্রিকেট দল বাংলাদেশের কাছে দাঁড়াতে পারবে না। হ্যাঁ, এটাই সত্য। এটাই বাস্তবতা।

বন্ধু ফোন কেটে দিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের এমন শোচনীয় হার মেনে নিতে পারছিলাম না। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট মাঠের গ্যালারিতে বসা প্রবাসী বাঙালিদের উচ্ছ্বাসমাখা মুখগুলো বারবার চোখের সামনে ভাসছে। টিভিতে দেখেছি তাদের। কাজ ফেলে, চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে তারা বাংলাদেশের খেলা দেখতে এসেছিল। সারাক্ষণ ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ বলে আনন্দে চিৎকার করেছে। তাদের কষ্ট জড়ানো অসহায় মুখগুলো চোখের সামনে ভাসছে। দেশের অবস্থা না-ই বা বললাম। ক্রিকেট হাসলে বাংলাদেশ হাসে। এটাই সত্যি। হাসতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। সেটা হলো না।

 

বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে কী শিখলাম আমরা?

 

কেন হলো না? এর ব্যাখ্যা কী? বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড হয়তো বলবেন, আমরা তো আগেই বলেছিলাম জেতার জন্য দল পাঠাইনি। শেখার জন্য পাঠিয়েছি। আবারও বোর্ডকে বিনীতভাবে সেই প্রশ্নটিই করতে চাই– বিশ্বকাপের মঞ্চ শুধু কি শেখার মঞ্চ? নাকি যোগ্যতা প্রমাণেরও মঞ্চ? একেবারে তারুণ্যনির্ভর একটি দল পাঠানো হলো বিশ্বকাপে খেলার জন্য। কিন্তু কেন? অন্যান্য দেশ নবীন প্রবীণের সমন্বয়ে গড়া দলই বিশ্বকাপে পাঠিয়েছে। সেখানে আমরা পাঠালাম একেবারেই তারুণ্যনির্ভর একটি দল। তরুণদের সঙ্গে প্রবীণদের অর্থাৎ সিনিয়র খেলোয়াড়দের কি পাঠানো যেত না? ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডব– মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ যখন দলে ছিলেন তখন দলটার মধ্যে এক ধরনের সাহস খুঁজে পাওয়া যেতো। মাশরাফি কেন দলে নাই সেটা আমরা জানি। কিন্তু বাকি ৪ জনের ৩ জন কেন দলে নেই তা কারও কাছে পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ কেন দল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেন সেটাও স্পষ্ট নয়। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, সিনিয়রদের ওপর ভরসা আর কতদিন? জুনিয়রদের তো সুযোগ দিতে হবে। কথা মানছি। তাই বলে বিশ্বকাপের মতো আসরে দলের সদস্য সবাই হবেন জুনিয়র? একটা ছোট্ট প্রশ্ন করতে চাই। ভারতের বিরাট কোহলি কতদিন ধরে ক্রিকেট খেলেন? প্রায় দুই বছর তিনি ক্রিকেটে ছিলেন নিষ্প্রভ। দলের জন্য তেমন কিছুই করতে পারছিলেন না। তবু তাকে দলে রাখা হয়েছিল। এর কারণ কী? কারণ একটাই, বিরাট কোহলি ভারতের ক্রিকেটের সেরা অনুপ্রেরণা। সেরা বিজ্ঞাপন। দলে বিরাট কোহলির মতো তারকা আছে ওটাই তো প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ের ব্যাপার। যেকোনও খেলায় প্রতিপক্ষ দল প্রথমে তারকা খেলোয়াড়কে খোঁজে। দলে যদি তারকা খেলোয়াড় থাকে তাহলে টেনশন শুরু হয়ে যায়। এবার বাংলাদেশ দলে একমাত্র সাকিব আল হাসান ছাড়া সেই অর্থে দ্বিতীয় কোনও তারকা খেলোয়াড় ছিলেন না। মুস্তাফিজ, সৌম্য সরকার, লিটন দাসও তারকা খেলোয়াড়। আমি তারকা খেলোয়াড় বলতে অভিজ্ঞতার কথা বলছি। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে অভিজ্ঞতাটাই সবচেয়ে জরুরি। দল সাজানোর ক্ষেত্রে আমরা কেন সে কথা মাথায় রাখিনি।

হ্যাঁ, আমি মানছি তারুণ্যই শক্তি। কিন্তু সেই শক্তি প্রতিষ্ঠায়ও তো একটা আন্তরিক গাইডলাইন জরুরি। খেলতে যাচ্ছি কার বিরুদ্ধে, কাদের বিরুদ্ধে এই সাহসটাও তো দিতে হবে তরুণদের। তার চেয়ে বড় কথা, বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার আগে দলের ভেতরে তো একটা প্রস্তুতি থাকা দরকার। কোথায় যাচ্ছি, সেখানে প্রতিপক্ষ কারা? তাদের খেলার টেকনিক কেমন? যাদের পাঠানো হচ্ছে সঠিক অর্থে তারাই যোগ্য কিনা? বিশ্ব আসরে দল পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ এই বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দেয়। এবার বিশ্বকাপে দল পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এই বিষয়গুলো কতটা গুরুত্ব দিয়েছে, আশা করি এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই কথা বলবেন। এখন প্রশ্ন হলো– শেখার জন্য বিশ্বকাপে দল পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। এই বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশ দল কি শিখলো? তার আগে একটা বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেটা হলো ২০২৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে টি-২০ বিশ্বকাপের আয়োজন করবে। ওই আসরে এবারের মতো সরাসরি কি অংশ নিতে পারবে বাংলাদেশ? এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে সম্ভাবনা আছে।

এখন প্রশ্ন হলো– বিসিবি শেখার জন্য বাংলাদেশ দলকে বিশ্বকাপে পাঠানোর যে পরিকল্পনার কথা বলেছিল তার ফলাফলটা কী? কেমন হলো বাংলাদেশের প্রস্তুতি? ভারতের সঙ্গে খেলার আগের দিন স্বয়ং সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, আমরা তো এই টুর্নামেন্টে জিততে আসিনি। কাজেই ভারতেরই দুশ্চিন্তা বেশি। আমরা যেকোনও সময় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারি। সাকিব একেবারেই মন্দ বলেননি। অঘটন তো একটা ঘটেই যাচ্ছিল। বিরাট কোহলির ফেক ফিল্ডিংয়ের বিষয়টি গুরুত্ব পেলে বাংলাদেশ বাড়তি ৫ রান পেতো। তখন ম্যাচের ফলাফল পাল্টে যেতো এটা নিশ্চিত। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলায়ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবিচার করা হয়েছে। সাকিব আল হাসানকে অন্যায়ভাবে আউট দেওয়া হয়েছে। দুটো ঘটনাই বাংলাদেশের জন্য অসম্মানজনক। দুটো ঘটনার একটিও ভারত-পাকিস্তানের পক্ষে হলে আম্পায়ার ঠিকই সিদ্ধান্ত দিতেন। তার মানে ক্রিকেট কূটনীতিতে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। একই সঙ্গে আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি ক্রিকেট সঠিক পথে হাঁটছে? অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কয়েকজন সদস্য, বিশেষ করে ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। আগের ম্যাচ হারার পরও কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও আরও অনেক অনিয়মের কথা শোনা যাচ্ছে। আমরা জানি না এ ব্যাপারে আদৌ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে কিনা।
আমাদের একটা কথা মনে রাখা উচিত, ক্রিকেট দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষের কাছে শুধু একটি খেলা নয়, মর্যাদার বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রিকেট হাসলে বাংলাদেশ হাসে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট কি সঠিক পথে হাঁটছে?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ