ড. মিল্টন বিশ্বাস
২০২৩ সালের ১৭ মার্চে এসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন এবং একইদিন জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য ‘সোনার মানুষ’ অন্বেষণ করতে হচ্ছে আমাদের। জাতির পিতার জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস উদযাপন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এরকম দিন এখনকার প্রজন্মের জীবনে সত্যিই অভিনব।তাছাড়া ১৯৯৭ সাল থেকে জাতীয় শিশু দিবস পালন করা শুরু হলেও বঙ্গবন্ধুকে নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ এ প্রজন্মের হয়েছে গত ১৪ বছরে। তারা জেনেছে, স্বাধীনতার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভালোবাসতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে আজকের শিশুদেরই। তাই শিশুরা যেন সৃজনশীল মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে তিনি সব সময়ই তা প্রত্যাশা করতেন। তিনি যে সোনার মানুষ খুঁজেছেন তা এই শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশের মধ্য দিয়ে তৈরি করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মাটির মানুষ ও সাধারণ মানুষের নেতা। এজন্য তাঁর সহজ-সরল আচরণ শত্রু-মিত্র সকলকে আকৃষ্ট করত। মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিত ছিলেন তিনি আজীবন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিন জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। কারণ তিনিও শিশুদের ভালোবাসতেন। বিশ্বের সকল মহামানব শিশুবান্ধব ছিলেন, শিশুদের প্রিয় ছিলেন। মহান নেতা হয়েও, রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ততা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কখনো তাঁর শিশুপুত্র রাসেলকে আদর করতে ভোলেননি। কোথাও যেতে তিনি রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। শিশু রাসেলও তাঁকে খুব ভালোবাসতো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতো। আব্বাকে মোটেই ছাড়তে চাইতো না।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘রাসেলের সব থেকে আনন্দের দিন এলো যেদিন আব্বা ফিরে এলেন। এক মুহূর্ত যেন আব্বাকে কাছ ছাড়া করতে চাইতো না। সব সময় আব্বার পাশে ঘুরে বেড়াতো।’ শিশুরা সুন্দর স্বপ্ন দিয়ে তাদের নিজস্ব জগৎ নির্মাণ করে। বঙ্গবন্ধুও তাঁর রাজনৈতিক জীবন স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেছিলেন। শিশুদের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেন।
পরবর্তীকালে তারই আলোকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, শিশু হাসপাতাল ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। এছাড়া শিশুদের জন্য আরো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুদের প্রিয়জন। শিশু-কিশোরদের কাছেও তিনি ছিলেন ‘মুজিব ভাই’। ১৯৬৩ সালে ঢাকা প্রেস ক্লাবে আয়োজন করা হয় দশ দিনব্যাপী শিশুমেলা। ওই শিশুমেলায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’
শামসুজ্জামান খান স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে- ‘১৯৬৩ সালে শেখ সাহেবকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখার ও কাছে পাওয়ার সুযোগ ঘটে। আমরা ওই বছরে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার উদ্যোগে ঢাকাস্থ প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে এক শিশু-কিশোর আনন্দমেলার আয়োজন করি। সেই মেলায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি আগ্রহসহকারে আসেন এবং মেলার প্রদর্শনী ও স্টল পরিদর্শন করেন।
আনন্দমেলার নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় দেখাশোনার জন্য কচি-কাঁচার মেলার সদস্যদের নিয়োগ করা হয়। পুলিশ বা শান্তিবাহিনি, গোয়েন্দা- সবই ছিল কচি-কাঁচার মেলার সদস্য। শেখ সাহেব যখন প্রদর্শনী দেখছিলেন তখন তাঁর কাছ থেকে মেলার গোয়েন্দা বাহিনি একটি লোককে আটক করে। তার চেহারা উসকো-খুশকো, গায়ে একটি কাঁথা জড়ানো। ক্ষুদে গোয়েন্দারা তার দেহ তল্লাশি করে তার কাছে মেলার একটি ম্যাপ ও কিছু কাগজপত্র পায় এবং পরে দেখা যায় ক্ষুদে গোয়েন্দারা যাকে পাকড়াও করেছে সে সরকারের আসল গোয়েন্দা। শেখ সাহেবের পিছু নিয়ে আনন্দমেলায় ঢুকেছে। শেখ সাহেব সরকারি গোয়েন্দাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘চান্দু, এখানেও আমার পিছু নিয়েছ- শিশুদের সঙ্গে একটু আনন্দ করবো তাতেও ফেউ লাগিয়ে রেখেছে সরকার। যা মাফ করে দিলাম।’ পরে দাদাভাইয়ের দিকে ঘুরে বললেন, দাদাভাই, আপনার গোয়েন্দারা সরকারি গোয়েন্দাদের উপর টেক্কা দিয়েছে, সাবাস!’
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর মার্চ মাসে রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। সে সময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য গণভবন ‘সুগন্ধা’য় উপস্থিত হন। সঙ্গে ছিলেন ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন ও লুৎফুল হায়দার চৌধুরী। শিশুদের আঁকা ছবিগুলো বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটু খানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ সোনার মানুষ ঠিক এরকমই চেয়েছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করেন। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্য এবং জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে করেন বাধ্যতামূলক। ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে করা হয় জাতীয়করণ। শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন প্রণয়ন করেন। এর ১৫ বছর পর জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ তৈরি করে। বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদের অন্যতম অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। গ্রহণ করা হয়েছে জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শিশু নীতিকে আরো যুগোপযোগী করতে ঘোষিত হয় শিশু আইন ২০১৩। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। পথশিশু, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। পরিত্যক্ত শিশুদের সেবা ও ভাতা প্রদান, পথশিশুদের পুনর্বাসনসহ তাদের জীবনমান উন্নত করতে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শিশু শিক্ষা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে স্কুল টিফিন, শিশুর জন্য নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন কার্যক্রম। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে করা হয়েছে জনকল্যাণমুখী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের ‘মহাকবি’, তিনি বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টিতে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’। তাঁর ছিল দুর্নিবার গ্রন্থপ্রীতি। তিনি ছিলেন সচেতন পাঠক। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, উইনস্টন চার্চিল, আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলা, জন এফ কেনেডি, ফিদেল ক্যাস্ত্রো প্রমুখ রাজনৈতিক নেতার মতো যখনই অবসর পেতেন তখনই তিনি বইয়ের বিচিত্র জগতে হারিয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধু যে প্রচুর শিল্প-সাহিত্যের বই পড়তেন তা তাঁর ভাষণ, বক্তৃতা, চিঠিপত্র আর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রবার্ট পেইন দেখেছেন, জর্জ বার্নার্ডশ, বার্ট্রান্ড রাসেলের রচনাবলি, মাও সেতুং স্বাক্ষরিত গ্রন্থ। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রেমী ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণকালে একই গাড়িতে করাচি আসার পথে উর্দুভাষী কয়েকজন পাকিস্তানিকে তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ২১৭) ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের শান্তি সম্মেলনে যোগদান করে তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ২২৮)
১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকদের রুদ্র রোষে ২৪টি মামলায় ১৮ বার জেলে নিক্ষিপ্ত হন শেখ মুজিব। তিনি সর্বমোট ১২ বছর জেল খেটেছেন। আর দশ বছর কড়া নজরদারিতে ছিলেন। জেলবন্দি নিঃসঙ্গ জীবনেও বই ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন। ২১ ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল থেকে বঙ্গবন্ধু একটি চিঠি লিখেছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। সেই চিঠিটি তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করলেও গবেষকরা পরবর্তী সময় উদ্ধার করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু আমার মা’র অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ড শ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেয়া ছিল। জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়, তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পরপর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলোতে ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মা’র সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বইকেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল। সেই বইগুলো ওরা (পাকিস্তানিরা) নষ্ট করে। বইয়ের প্রতি ওদের আক্রোশও কম না। আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ (শেখ হাসিনা: শেখ মুজিব আমার পিতা, আগামী প্রকাশনী, ২০১৪, পৃ ৭০-৭১)
বঙ্গবন্ধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কেবল সাধারণ মানুষ কিংবা কৃষক-শ্রমিকদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলেন না তিনি ছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি। স্বাভাবিকভাবে স্বীয় শ্রেণির শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। তাছাড়া পূর্বেই বলা হয়েছে তিনি সাহিত্যের একজন অনুরাগী পাঠক ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন- ‘শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে-কোনো অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে।’ (আতিউর রহমান, ‘বাঙালি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু’) ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করে ঢাকায় নেন। ১৯৭২ সালের ২৫ মে ঢাকায় কবির বাসায় যাবার সময় ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর থেকে বের হয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করতে করতে পথ হেঁটেছেন বঙ্গবন্ধু। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র সূত্র অনুযায়ী আব্বাসউদ্দিনের ভাটিয়ালি গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। এই কণ্ঠশিল্পীর বাংলা ভাষা রক্ষার আকুতিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে অবদান রাখেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হয়েও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছিলেন- ‘এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনির মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না।’ (দৈনিক ইত্তেফাক ১৬/২/১৯৭১) তার আগে ৯ জুন ১৯৬৯ সালে বাংলার সবচাইতে জনপ্রিয় সাংবাদিক ‘মানিক ভাই’ প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন- ‘তিনি ছিলেন এক সার্বক্ষণিক প্রেরণা। অতি বড় দুর্দিনেও তাঁর উপর আমরা ভরসা রাখতে পেরেছি। কাছে গিয়ে সাহস ফিরে পেয়েছি। তিনি নিষ্ঠাবান সংগ্রামী ছিলেন। সংগ্রামীদেরকে তিনি ভালোবাসতেন।’ (বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম) বেবি মওদুদ লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে ক্ষতিগ্রস্ত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দুটিকে বিজয় লাভের পর পুনরায় নিজের পায়ে দাঁড় করাতে সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।’ (সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও শেখ মুজিব, ২০১৩) বঙ্গবন্ধুর শতাব্দীতে কয়েকটি দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদও ছিলেন কোনো না কোনো পত্রিকা বা রাজনৈতিক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। মহাত্মা গান্ধী নিউ ইন্ডিয়া, মতিলাল নেহরু ইন্ডিপেনডেন্ট, মাওলানা মোহাম্মদ আলী কমরেড, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বেঙ্গলি, জওয়াহেরলাল নেহরু ন্যাশনাল হেরাল্ড, অরবিন্দ ঘোষ বন্দেমাতরম, সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড, বিপিন চন্দ্র পাল ইয়ং ইন্ডিয়া, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নারায়ণ, ফজলুল হক কৃষক ও নবশক্তি পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন নতুন দিন, ইত্তেহাদ, ইত্তেফাক, মিল্লাতসহ কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সবসময়ই কাছে পেয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের। জসীম উদদীন, সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, হাশেম খান, সমরজিত রায় চৌধুরী প্রমুখ কবি ও চিত্রশিল্পী এবং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক ছবি রয়েছে। ১৯৭৩ সালে ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের মাঝেও তাঁকে দেখা গেছে। ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে তিনি বলেন- ‘মানবাত্মার সুদক্ষ প্রকৌশলী হচ্ছেন দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী।’ সোনার মানুষ গড়ে তোলার জন্য এঁদের ভূমিকা ছিল মুখ্য।এজন্য তাঁদের প্রতি তাঁর প্রাণের টান এতো। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতিচারণ-এ আছে, ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মন্মথ রায়কে বাম পার্শ্বে ও তাঁকে দক্ষিণ পার্শ্বে বসিয়ে সেদিন নানা অন্তরঙ্গ কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি অসুস্থ কবি হুমায়ূন কাদির, আবুল হাসান ও মহাদেব সাহাকে সুচিকিৎসার জন্য বার্লিন, মস্কো, লন্ডন প্রেরণ করেন এবং একটি কবিতা লেখার জন্য দাউদ হায়দারকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা এবং নিরাপত্তা দিয়ে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কবি আল মাহমুদকে জেল থেকে মুক্ত করে শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি ছিলেন নাটকের একজন সুহৃদ। টেলিভিশন ও মঞ্চ নাটকের ওপর থেকে প্রমোদকর ও সেন্সর প্রথা সহজতর করেছিলেন নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তাঁর অবদান ছিল। প্রাদেশিক পরিষদে এফডিসি’র বিল উত্থাপন করেন বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল। তখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ছিল চলচ্চিত্র বিষয়ক দপ্তর। ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয় বাংলাদেশের ১৮ এবং ভারতের ৪ জন বিশিষ্ট শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতারকর্মীকে। অর্থাৎ কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নে তিনি যুক্ত করেছিলেন শিক্ষক-প্রকৌশলী ও পেশাজীবীদের, শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রশাসনের সঙ্গে রেখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতাই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্থ ছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার পঙক্তি- ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, / রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি’ এবং ১৯৭২ সালের ৭ ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেবার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ‘নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি’ এবং ‘নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস’ তাঁর কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল বেশি। তাঁর অন্তর দখল করে রেখেছিলেন বিশ্বকবি। রাজনৈতিক জীবনে দুঃখ-দৈন্য-সংকটে আবৃত্তি করতেন- ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা’ কিংবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে…’ বহুল পরিচিত চরণসমূহ। জেলে যাবার সময় ‘সঞ্চয়িতা’ হাতে তুলে নিতেন। বোঝা যায় একমাত্র সঙ্গী বা অনুপ্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে তিনি বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বাজাত্যের যে চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে সকালের নাস্তা সারতেন। এক স্মৃতিচারণে মাহবুব তালুকদার টুঙ্গিপাড়ার সফরসঙ্গী হিসেবে সকালে ঘুম থেকে উঠে বঙ্গবন্ধুকে নৌযানে বসে নদীর দুপাড়ের গ্রাম-বাংলার দৃশ্য দেখে আবৃত্তি করতে শুনেছিলেন- ‘নম নম নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি/ গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি’ রবীন্দ্র পঙক্তিমালা। জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি ১৯৫৬ সাল থেকেই তাঁর প্ররোচণায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালে ঠিক করে ফেলেন সোনার বাংলা গড়ার। গানটি সর্বত্র প্রচারে শেখ মুজিবের সক্রিয় ভূমিকার কথা জানিয়েছেন প্রফেসর ড. সনজীদা খাতুন। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ মে ২০০৫) প্রকৃতপক্ষে সোনার বাংলাদেশে সোনার মানুষের প্রত্যাশিত অবদান তিনি চেয়েছেন অন্তর থেকে।
শিল্প-সংস্কৃতির একজন রসবোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশ-বিদেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের গভীর সম্পর্ক ছিল। এজন্য ১৫ আগস্টের (১৯৭৫) হত্যাকাণ্ড রাজনীতিবিদদের সাথে সাথে অভিঘাত রাখে শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিদের চেতনায়। পরবর্তীতে তাঁরা তাঁদের লেখনিতে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। মূলত জাতিকে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে প্রেরণা যুগিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য সমাজের ব্যক্তিবর্গ।
বঙ্গবন্ধুর শিল্প সংস্কৃতি ভাবনায় শিশু এবং দুঃখী মানুষের কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বিস্তর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁ-এ ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’ স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায়। ১৯৭২ সালের ১-৫ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে সেখানকার নেতৃবৃন্দের জন্য উপহার হিসেবে তিনি নিয়ে যান কচি-কাঁচার মেলার শিশুদের আঁকা চিত্রকর্ম। রাজনীতি করে যেমন গরিব কৃষক ও শ্রমিকের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন তেমনি শিল্প-সংস্কৃতির চেতনাসম্পন্ন উপযুক্ত জাতি গঠনে নিবেদিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
রাজনীতির অমর কবি বঙ্গবন্ধুর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অঙ্গীকার পরবর্তীকালে দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকরা ভুলতে পারেননি। দেশ পরিচালনায় খুব কম সময় পেলেও তাঁর আত্মবলিদান প্রেরণার শতধারায় উৎসারিত এখনও। তাঁকে আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী করে তুলেছেন শিল্পী-সাহিত্যিকরা সৃষ্টি হয়েছে কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, চিত্রকলা। আদর্শের মৃত্যু নেই যেমন কবি পাবলো নেরুদা লিখেছেন- ‘কোনো কোনো রক্তের দাগ কিছুতেই শুকোবার নয়।’ বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। প্রেরণার উৎসে মহীরুহ তিনি। এজন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের জাগরণ হলো। বিনা দ্বিধায় আমরাও বলে উঠলাম, ওই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যতদিন লড়াই চলবে, ততোদিন আমরাও সঙ্গে আছি। বাঙালি হিসেবে আমরাও সহযোদ্ধা।’ (আমরা কি বাঙালি) ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেওয়া মন্মথ রায় লেখেন (আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন স্মরণিকা) ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অবলম্বনে লিখিত আমার দুইটি নাটক এক. স্বাধীনতার ইতিহাস, দুই. আমি মুজিব নই- গ্রন্থ দুইটি তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে ধন্য হতে পেরেছিলাম।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির ১০ ধারায় মৃতব্যক্তির মাহাত্ম্য প্রচার নিষিদ্ধ করে খুনি সরকারের তরফ থেকে এক ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে ২১ বছর ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯৬ থেকে পুনরায় ব্যবহৃত হতে থাকে শব্দটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার যুগ শুরু হয়। একইসঙ্গে জাতীয় শিশু দিবসের প্রচলন সেই আমল থেকেই। তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা সরকার গত ১৪ বছর যাবৎ সোনার মানুষ গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেছে এবং এগিয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে।আর এই ভবিষ্যতের বাংলাদেশে স্মার্ট নাগরিককে অবশ্যই সোনার মানুষ হতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।