মোঃ মহিউদ্দিন
“তোমার জন্ম আমাদের স্বাধীন করেছে,
এক পরাধীন জাতীর সেঁকল খুলেছে
এক নত জাতীর মস্তকে মহিমান্বিতের বার্তা দিয়েছে”
এই ইতিহাস ভুলে যাবো ? আমি কি তেমন সন্তান? যখন আমি বাঙালী, আর জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি, চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি”
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর অবদানের পাশাপাশি তাঁর জন্মের তিথিও চিরজাগরূক থাকবে বাঙালীর প্রাণের স্পন্দনে। দু’শ’ বছরের পরাধীনতার জিঞ্জির ছিঁড়ে বাঙালীকে মুক্তির সাধ এনে দিতে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাঙালীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে জন্ম নেন এই মহানায়াক।
বঙ্গবন্ধু তার জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিনে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী? উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, জনগণের সার্বিক মুক্তি। এরপর তিনি বেদনার্থ স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু।’
বাঙালি জাতি ভাগ্যবান। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বহুগুণে গুণান্বিত একজন রাজনৈতিক নেতা পেয়েছিল। তিনি শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেতা, দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, একজন দুর্জয় সাহসী রাজনীতিক, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, মানবিক গুণসম্পন্ন একজন মহান মানুষ, একজন অসাধারণ ব্যক্তি এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় নেতা ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির অভিভাবক।
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। জাতির জন্য সঠিক আদর্শ ও সঠিক পথটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মর জন্য তিনি রচনা করে গেছেন।
বাল্যকাল ও কৈশোর থেকে সংগ্রাম শুরু করা বঙ্গবন্ধু সারাজীবন একটিই সাধনা করেছেন- আর তা হচ্ছে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। সেটি প্রমাণ করে গিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে। এখন ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’- দুটি নাম একটি ইতিহাস। এক এবং অভিন্ন সত্তা। যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট গঠন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথম প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। বাঙালী ফিরে পায় তার প্রানের ভাষা ।
ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেন দূরদর্শীতা এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন এক কুশলী রাজনৈতিক নেতা। এসময় শেখ মুজিব, হোসেন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানী মিলে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। তিনি দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি মন্ত্রী হন মুজিব। ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি।
১৯৬৩ সালে হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। তিনি ছিলেন আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র তত্ত্বের কট্টর সমালোচক। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। এই ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের রূপরেখা।
মুজিবের ৬ দফার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থনে ভীত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার সমস্ত জনগণ। জনরোষের কাছে নতি স্বীকার করে এক পর্যায়ে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শোষকগোষ্ঠী।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়৷সেখানেই উত্থাপিত হয় এগার দফা দাবি যার মধ্যে ছয় দফার সবগুলোই দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। লাখো মানুষের এই জমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়৷
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বলেন,… জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ”।
বাঙালি জনমানুষ যখন আন্দোলিত হচ্ছিল, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। তখন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বজ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি প্রথমে মুক্তি ও পরে স্বাধীনতার কথা বলেন। তীক্ষ্মদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষটি স্বচিত্তে মুক্তির জন্য যে স্বাধীনতার প্রয়োজন তা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন। মুক্তি মানে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে মুক্তি। একটা স্বাধীন জাতিই কেবল পারে ওই ধরনের মুক্তির প্রত্যাশা করতে। তাই তার ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাদ করে তোলে।
‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ এবং ‘যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করো’ এসব কথার মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। এমনকি ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি’ উচ্চারণের মধ্যে ছিল জাতির মুক্তি আন্দোলনে নিবেদিত অন্যান্য নেতাকর্মী ও আপামর জনতার বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর মুক্তিমন্ত্র।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হবার একটু আগে ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর (২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ই. পি. আর এর ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়।
ঘোষণাটা ছিল এমন ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চুরান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে’।
আজ অনেকে ঘোষক নিয়েও বিতর্ক করে। নাম পরিচয় হীন কারো ঘোষণা পাঠ শুনে বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। যদিও সেই ঘোষণাও বঙ্গবন্ধুর বরাত দিয়েই পাঠ করা হয়েছিল। পাঠকদের উদ্দেশে সেই ঘোষণাটি তুলি ধরছি । এখানে বলে রাখি মেজর জিয়াউর রহমানের আগে ২৬ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে’র প্রথম দিন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন- আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান, আবুল কাশেম সন্দীপ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক এবং সুলতানুল আলম।
এর পরের দিন ২৭ মার্চ ১৯৭১ এ মেজর জিয়াউর রহমান ঘোষণাটি পাঠ করেন সেটা ছিল হুবহু এমন…………………..
‘I, Major Zia, on behalf of our Great Leader, the Supreme Commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, do hereby proclaim the independence of Bangladesh and that the government headed by Sheikh Mujibur Rahman has alreadz been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of 75 million people of Bangladesh and the government headed by him is the only legitimate government of the people of the independent sovereign state of Bangladesh, which is legally and constitutionally formed and is worthy of being recognised by all the governments of the world. I, therefore, appeal on behalf of our Great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the democratic countries of the world, especially the Big Powers and the neighbouring countries, to recognise the legal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. To dub us, the elected representatives of the majority of the people, as secessionists, is a cruel joke and should befool none.The guiding principle of the new state will be, first, neutrality; second, peace; third, friendship to all and enmity to none. May Allah help us.Joy Bangla.
সেদিন জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে, বঙ্গবন্ধুকে সুপ্রিম কমান্ডার, মহান নেতা, বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের ‘সোল লিডার’ আখ্যা দিয়ে ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন। তিনি ঘোষণাপত্রের একজন পাঠক। এমএ হান্নানও তেমনি একজন পাঠক।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত ঘোষণাপত্রটি ইপিআর, রাজারবাগ পুলিশলাইন্সের ওয়্যারলেস যারা এটি পাঠ করেছেন, তারাও পাঠক। তাহলে কী জন্য, কী কারণে, কিসের ভিত্তিতে জিয়াউর রহমানকে আপনারা ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে দাবি করেন। আপনাদের আসল উদ্দেশ্য কী? জিয়াউর রহমানকে সম্মানিত করতে গিয়ে মিথ্যাচার করার কোনো মানে হয় না। এতে জিয়াউর রহমান দিন দিন ছোটই হবেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনি তুলনীয় নন।
তাই আসুন নিজস্ব স্বার্থকে বড় করে না দেখে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করি। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে মানুষের কল্যাণে, উন্নত, সুখীসমৃদ্ধ, সুসভ্য, আধুনিক ও মুক্তিযুদ্ধচেতনা নির্ভর রাষ্ট্র গড়ার কাজে হাত বাড়াই। বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে সোনার বাংলা গড়ায় আমাদের জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার অঙ্গীকার করি।
জয় বাংলা।
লেখক- মোঃ মহিউদ্দিন,সিনিয়র অফিসার, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ।