মতামত:
‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃঙ্খলিত বৃক্ষের ঊর্ধ্বমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।…’ –আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
আজ ৩০ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। ব্রিটিশ-বিরোধী প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন দুই ভাই সিধু ও কানু মুর্মু। তাই কেউ কেউ আজকের দিনটিকে ‘সিধু-কানু দিবস’ও বলেন। কেউ কেউ বলেন ‘হুল দিবস’।
সাঁওতালরা পরগনার গহীন অরণ্যে বাসযোগ্য জনপদ গড়ে তোলেন দামিন-ই কোহ-তে। দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব জনপদ। ভাগলপুরের ভগনা ডিহি গ্রামের সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব–এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে দামিন-ই-কোহ অঞ্চলে সংঘটিত হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ। সেই সময়ে বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে শুরু হয়েছিল লগ্নি পুঁজিবাদের উত্থান।
এই সময় বিশ্বের সব থেকে বড় বঙ্গীয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে ‘দামিন-ই কোহ’ তে ধান, সরষে ইত্যাদি কৃষি পণ্য সংগ্রহের ব্যবসায় আসা শুরু করল স্থানীয় ফড়িয়া, দালাল, মহাজনেরা। কৃষিপণ্যের বিনিময়ে চরমভাবে ঠকানো হতো সামান্য অর্থ, লবণ, তামাক বা মোটা কাপড় দিয়ে।
ফসল কাটার মৌসুমে একটি সিঁদুর মাখানো পাথরকে নির্ভুল বাটখারা হিসেবে ব্যবহার করে ওজনে কারচুপি করত ফড়িয়ারা। ফলে সাঁওতালরা এই মিথ্যে ওজনের পাথরের ফাঁদে বেশি শস্য দিয়ে কম মূল্য পেত। এই ফাঁদে চক্র বৃদ্ধি হারে বাড়তো সুদের বোঝা। ফলে ক্রমাগত ঋণখেলাপি হতে হয়ে সর্বস্ব হারাত সাঁওতালরা। এই ফাঁকে সূচ হয়ে ঢুকতো উচ্চহারের সুদ। এই ঋণ চুকাতে তাঁকে বিক্রি করে দিতে হতো ফসল, তারপর হালের বলদ, শেষ পর্যন্ত নিজেকে।
ইতিহাস বলে, সহজ সরল সাঁওতাল সমাজ ১০ গুণ বেশি ঋণ পরিশোধ করলেও একফোঁটা ঋণ মওকুফ হতো না।
পুঁজিবাদকে ভূমিপুত্রদের শোষণের জন্য একদিকে স্থানীয় সামন্ত জমিদার ও তাদের গোমস্তা, পেয়াদা; অন্যদিকে সুদখোর মহাজন, তাদের পোষ্য পাইক-বরকন্দাজ, লাঠিয়াল বাহিনী জোট পাকালো দারোগা-পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে। ফলে শেষ পর্যন্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল ভূমিপুত্রদের। সেই নিদারুণ দ্রোহকালে বিদ্রোহ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব–এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ায় সাঁওতাল সমাজ। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই বোন ফুলোমণি ও ঝালোমণি মুর্মু। লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। এই যুদ্ধে সাঁওতালদের দিকে তীর ধনুকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো ইংরেজ বন্দুক-কামান। শহিদ হন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। প্রজন্মান্তরের নিপীড়নের অবচেতন হাতের অনুভব আমরা এখনো করি। বিশ্বাস হচ্ছে না?
একবার একটু খেয়াল করুন তো রং ফর্সা করার ক্রিমের বিজ্ঞাপন কেন এখনো আমরা উৎসাহিত করি? এপিজেনেটিক্স বলছে, বংশ পরম্পরায় জিনের ওপরে এখনো প্রজন্মান্তর ক্ষত প্রভাব বিস্তার করে। একজন মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় আসে ইতিহাস থেকে। কিন্তু ঔপনিবেশিকতা সেই ইতিহাসকে বিকৃত করে ফেলে। ক্রমাগত এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলে একজন মানুষ তার অতীত থেকে দূরে সরে যায়। যেখানে ইতিহাস সংস্কৃতি জাতির মজ্জায় ঘুণ ধরে যায়। স্টুয়ার্ট হাল বলেছেন, এই যে বারবার পরিবর্তন হচ্ছে, এই পরিবর্তন একজন মানুষের পরিচয়কে বদলে ফেলেছে। ফলশ্রুতিতে মানুষটির নির্দিষ্ট পরিচয় আর থাকছে না, ক্রমাগত তার নতুন নতুন পরিচয় বিকশিত হচ্ছে। যার ফলে মানুষটির নিজস্ব সংস্কৃতি এত বেশি খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে যে, কোনটা তার নিজস্ব সংস্কৃতি সে নিজেই ভুলে যাচ্ছে। বাইরে থেকে ঔপনিবেশিক শক্তি ভূমিপুত্র বা স্থানীয় জনগণের ইতিহাসকে বদলে ফেলছে। এই বদলে ফেলার নাটক প্রভাবিত করছে মানুষের সংস্কৃতিকে। এই ঘটনা অনেক বেশি মাত্রায় ঘটছে আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে বিশেষ করে পাক ভারত উপমহাদেশে যেখানে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বহু ভাষাভাষী মানুষ রয়েছেন।
তাই আমাদের বারবার মনে রাখতে হবে, সাঁওতাল বিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতিহাস। যেখানে পাখির মতো গুলি করে মারা হয়েছে একের পর এক সরল নিরীহ মানুষকে তারই জন্মভূমিতে বেনিয়ারদের লোভের বলি চড়াতে। উত্তর প্রজন্ম হিসেবে কৃতজ্ঞতা জানানো তাই এখন আমাদের কর্তব্য। বিঔপনিবেশায়ন এখন সময়ের দাবি।
সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, ফুলোমণি, ঝালোমণি এবং নাম না জন্য সেই সব শহীদ জন, আমরা আপনাদের এই ২০২৪ সালেও ভুলিনি। ভুলবো না কোনোদিন।
লেখক:
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার