গণতান্ত্রিক-ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন
মো: মাঈন উদ্দীন
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনের অনন্য ভাষণ বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি কেড়েছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের যে পথ সৃষ্টি হয়; তার চিত্র বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন তিনি।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার ১২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের সাথে বৈঠক ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারের বিশিষ্টতা দিয়েছে; যা আমাদের আগামী দিনের পথ চলা সহজ করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধ বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিলেন, সেই মূল্যবোধ বহু বছর পর আমাদের ‘জেনারেশন জি’ (প্রজন্ম জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। এ রকমটি আমরা দেখেছিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময়েও। বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।’
ছাত্র-জনতার অদম্য সঙ্কল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ সম্মিলিত সঙ্কল্পের মধ্যে দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত, যা বাংলাদেশকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত করবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা এ মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জনগণ দেখতে পান বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার কিভাবে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, কিভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, কিভাবে জনগণের অর্থসম্পদ নিদারুণভাবে লুটপাট করা হয়েছিল, কিভাবে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সব ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।
এককথায়, কিভাবে প্রত্যেকটি পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সুশাসন ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ড. ইউনূস বাংলাদেশের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সাথে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে এটা আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেইনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহতকরণেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাষ্ট্রব্যবস্থার সব পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই আমাদের অভীষ্ট।’
ভাষণে ড. ইউনূস অবৈধ অর্থের প্রবাহ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদের পাচার বন্ধের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। এ জন্য তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদারের কথা বলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণ দেয়ার আগে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরের সভাকক্ষে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠক বিরল। প্রথা ভেঙে এ বৈঠকে বাইডেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়ে বাংলাদেশের সংস্কারে সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানান।
প্রধান উপদেষ্টার সাথে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি বিøনকেনের বৈঠকেও সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে বলে জানানো হয়। দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তলানিতে গিয়ে পৌঁছে। গুম, বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ড, ভিন্নমত দমন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহায়তার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উত্তরণ ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভ‚মিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। প্রধান উপদেষ্টার সাথে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম এ এ খানের বৈঠকটি জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারের ক্ষেত্রে একটি নতুন পথ খোলার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। এবার জাতিসঙ্ঘে আমাদের সদস্যপদ লাভের ৫০তম বার্ষিকীও উদযাপন করা হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শীর্ষ ব্যক্তি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের নেতারা এসেছিলেন। কাজেই সেটাও আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৭৪ সালে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ সদস্যপদ পায়।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণের কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সংস্কারের জন্যও পৃথক কমিশনসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন। ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোনো বিদেশী ব্যবসা বা বিনিয়োগ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতেও বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর।
গণতান্ত্রিক উত্তরণে সরকারের ভূমিকার প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব সংস্কার যেন টেকসই হয়, তা দীর্ঘ মেয়াদে নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে ড. ইউনূস বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার আহ্বান জানান।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু নিজের দেশকে নিয়ে নয় বিশ্বের নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর অমানবিক বর্বরোচিত হামলারও তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, বিশ্ববাসীর উদ্বেগ এবং নিন্দা সত্তে¡ও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা কেবল আরব কিংবা মুসলমানদের জন্যই উদ্বেগজনক নয়, বরং তা সমগ্র মানবজাতির জন্য উদ্বেগের। একজন মানুষ হিসেবে প্রত্যেক ফিলিস্তিনির জীবন অমূল্য। ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়বদ্ধ করতে হবে।
ড. ইউনূস বলেন, ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা, বিশেষত নারী ও শিশুদের সাথে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারে বাংলাদেশ অবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারবে। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবাইকে এর বাস্তবায়নে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা, পরিবেশগত দিকসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ এক অনন্য রূপ ধারণ করে যা বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গত একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেক কাজ ও পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণকে অন্যায়, জুলুম ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের গহ্বর থেকে উঠিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়াই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ। কিন্তু এর জন্য রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে হবে। কারণ স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা ঘাপটি মেরে এখনো বিভিন্ন পদে বসে আছে। এদের চিহ্নিত করে সরাতে না পারলে, স্বৈরাচারের কৌশলীদের গ্রেফতার না করলে, উপযুক্ত বিচারের আওতায় না আনলে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে স্বপ্নের কথা, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বিশ্বদরবারে প্রকাশ করেছেন তা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও কঠোর পদক্ষেপ।
রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনীতিবিদরা একটি নির্দিষ্ট সময় দিতে চান। তারা চাচ্ছেন সুনির্দিষ্ট পথরেখা। সংস্কারের কথা বলা হলেও এগুলো করতে হলে সময় প্রয়োজন। সংস্কারকাজে এত দীর্ঘ সময় নেয়া হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে, জাতি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। তাই জনপ্রত্যাশা, সংস্কারের পরিধি কমিয়ে আনতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে হবে। এজন্য দরকার দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী, প্রয়োজনে নতুন পুলিশ নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি আর্থিক খাত বিশেষ করে ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনা ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের পথ সুগম করা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, আশা করা যায় শিগগিরই এ খাত ঘুরে দাঁড়াবে।
পতিত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করেছেন মূলত গণতন্ত্র তথা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ শাসনের উদ্দেশ্য সামনে রেখে। সুতরাং বর্তমান সরকারের প্রধান নিশানা হওয়া উচিত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে সরকার গঠন। এ দেশ সমস্যায় জর্জরিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন কাজ। একইসাথে তা দীর্ঘমেয়াদি। রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘমেয়াদের কাজগুলো সম্পাদন করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে ধারাবাহিক সরকারগুলোর সদিচ্ছার ওপর।
অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বসা উচিত বলে আমরা মনে করি। তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে জরুরি সংস্কারের খাতগুলো এবং নির্বাচনের পথরেখা। তখন জনগণের মাঝে জেগে উঠবে কাক্সিক্ষত আশা। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন ফিরে আসুক। জাতিসঙ্ঘে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনন্য ভাষণের সার্থকতার প্রতিফলন ঘটুক- এটা সবার প্রত্যাশা।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার।