পথে প্রান্তরে ডেস্ক \ ২৪ আগস্ট, ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরে কতিপয় পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন কিশোরী ইয়াসমিন। প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমে পুলিশের গুলিতে নিহত হন পাঁচজন। সেই থেকে দিনটি নারী নির্যাতন ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরের কয়েকজন বিপদগামী পুলিশ সদস্য ওই কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। ওই ঘটনার পর থেকেই দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে নিহত ইয়াসমিনের মা শরিফা বেগম বুধবার তার গোলাপবাগ বাড়িতে কোরআন খানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। এছাড়াও মহিলা পরিষদ জেলা শাখা দিনাজপুরের ইয়াসমিন চত্ত্বরে মানববন্ধনের কর্মসূচি পালন করে। এমবিএসকে, পল্লীশ্রীসহ বেশ কিছু নারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়াসমিনের কবর জিয়ারত, দিনব্যাপী দোয়া-মাহফিল, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সর্বস্তরের মানুষ। তখন প্রতিবাদী মানুষের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে দিনাজপুর শহরের সামু, সিরাজ, কাদেরসহ ৭ জন নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত হন। এরপর তৎকালীন দিনাজপুর সিআইডি জোনের এএসপি আফজাল আহমেদ বাদী হয়ে অভিযুক্ত ৩ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি মাহফুজার রহমান তদন্ত শেষে তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেবসহ ৯জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। মামলাটি নিরাপত্তাজনিত কারণে দিনাজপুর থেকে রংপুরে স্থানান্তর করা হয়। তৎকালীন রংপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মতিনের আদালতে ইয়াসমিন হত্যা মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে ২০০৭ সালের ৩১ আগস্ট ৩ পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদন্ড আদেশ দেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের দেয়া রায় পরে উচ্চতর আদালতে বহাল থাকে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন-পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার এবং পিকআপ চালক অমৃত লাল। তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।
বর্বরোচিত সেই ঘটনাঃ-
দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার গরিব ঘরের শরীফা বেগমের মেয়ে ইয়াসমিন। গরিব পরিবারে জন্ম নেয়ায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পেরেছিলেন। টাকা জমিয়ে আবার লেখাপড়া করার স্বপ্ন বুকে নিয়েই পাড়ি জমান ঢাকায়। ঢাকায় এসে একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেন। আট-নয় মাস কাজ করার পর নিজের বাড়িতে যেতে চান। কিন্তু গৃহকর্তা তাকে দুর্গা পূজায় বাড়িতে যেতে বলেন। কিন্তু মায়ের জন্য মন ছুটে যায় ইয়াসমিনের। আর সে কারণেই হয়তো ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ইয়াসমিন।
১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন। ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়ে সে। বাসটি রাত ৩টার পরে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় এসে পৌঁছায়। তিন রাস্তার মোড় বলে সেখানে রাতেও চায়ের স্টল, খাবারের দোকান প্রায়ই খোলা থাকে। বাসের সুপারভাইজার খোরশেদ আলম ও হেলপার সিদ্দিকুর রহমান ইয়াসমিনকে সেখানে নামিয়ে জনৈক চা দোকানদার জোবেদ আলীকে অনুরোধ করেন, যেন ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী কোনো গাড়িতে উঠিয়ে দেন। সে সময় জয়ন্ত নামে একজন যাত্রীও বাস থেকে নামেন। বাস থেকে নেমে জয়ন্ত ও ইয়াসমিন জোবেদ আলীর চায়ের দোকানের পাশেই একটি দোকানে নাস্তা খায়। আবদুর রহিম নামে এক পান দোকানদার ইয়াসমিন কীভাবে দিনাজপুরের শহরে যাবে জানতে চাইলে জয়ন্ত তাকে পৌঁছে দেবে বলে জানান। এ সময় উপস্থিত কয়েকজন আপত্তি জানিয়ে ইয়াসমিনকে তারাই দিনাজপুরগামী গাড়িতে তুলে দিতে চান।
এরপর পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের (নং-ম-০২-০০০৭) চালক অমৃতলাল বিষয়টি জানতে চান। পিকআপ ভ্যানে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল এবং আব্দুস সাত্তার বসে ছিলেন। অমৃতলাল এ সময় ইয়াসমিনকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে ইয়াসমিন সকাল না হওয়ায় যেতে সাহস পায়নি। এরপর অমৃতলাল ধমক দিয়ে তাকে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যান।
পরে ওই এলাকার লোকজন রাস্তা রক্তের দাগ, পাশে ইয়াসমিনের জুতা, রুমাল, হাতপাখা ও ভাঙা চুড়িও পড়ে থাকতে দেখেন। এর ঘণ্টা তিনেক পরে গোবিন্দপুর সড়কে ব্র্যাক অফিসের সামনে ইয়াসমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়।
এরপর উত্তর গোবিন্দপুর এলাকায় পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশে কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) স্বপন কুমার প্রকাশ্যে লাশ বিবস্ত্র করে ফেললে উৎসুক জনতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ঘটনার পরদিনই দিনাজপুরে এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে এবং হত্যা ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দিনাজপুর কোতোয়ালি পুলিশ বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য একজন অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ উদ্ধার মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা করে। লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বালুবাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের কোনো ধরনের গোসল ও জানাজা পড়ানো হয়নি।
২৫ আগস্টের বিক্ষোভে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সামু, সিরাজ, কাদেরসহ ৭ জন। পরবর্তীতে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বিক্ষুদ্ধ জনতা দিনাজপুর কোতয়ালী থানা, ৩টি পুলিশ ফাড়ি, কাস্টমস গোডাউন, ৪টি পত্রিকা অফিসসহ বেশ কিছু স্থাপনা ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়। ঘটে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা।
ইয়াসমিনের স্মরণে দিনাজপুরের দশ মাইল এলাকায় জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি এর পরিকল্পনায় তৈরি করা হয়েছে ইয়াসমিন স্মরণী। পাশে তৈরি হয়েছে, ইয়াসমিন যাত্রী ছাউনি ও পাঠাগার। এ ঘটনায় সম্মিলিত নারী সমাজের পক্ষ থেকে ‘২৪ আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২৪ আগষ্ট এই দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন।