স্টাফ রিপোর্টার- বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে ২৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী এসব তথ্য জানান।
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠকের শুরুতে প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
নিজাম উদ্দিন হাজারীর প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯-১০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ২৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এরমধ্যে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।’
সরকারদলীয় সংসদ মোজাফফর হোসেনের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী জানান, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের পাওনা ১ হাজার ৮৯৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এরমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে পাওনা ৯০৫ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৩৯৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি বিভিন্ন দফতর ও সংস্থা নিয়মিতভাবে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করায় বিপুল অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আছে। তবে তদারকি জোরদার করে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করায় গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ বিলের বকেয়ার পরিমাণ কমানো সম্ভব হয়েছে।’
প্রতিমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে ৮৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, জননিরাপত্তা বিভাগের কাছে ৬৪ কোটি ২২ লাখ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে ৬৩ কোটি ৬১ লাখ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কাছে ৪৩ কোটি ৫৬ লাখ এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ৩৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা পাওনা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের।
বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া আদায়ে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জানিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া কমানোর জন্য পর্যায়ক্রমে সব গ্রাহককে প্রিপেইড/স্মার্ট মিটারের আওতায় আনা হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫১ লাখ ৭ হাজার ৪৫২টি প্রি-পেইড/স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে আরও ২০ লাখ প্রি-পেইড/স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হবে।’
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমানা আলীর প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত তিন মেয়াদে এখন পর্যন্ত ১৯ হাজার ৯৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। যাতে গ্রিড, অফগ্রিড ও ক্যাপটিভসহ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য এম আব্দুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে নসরুল হামিদ বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশগুলো জ্বালানি সংকটে আছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতও এর বাইরে নয়। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশ বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার ও পরিকল্পিত লোডশেড করার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের চেষ্টায় আছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্রিডে যুক্ত হওয়াসহ সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে অচিরেই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে।’
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য লুৎফুন নেসা খানের প্রশ্নের জবাবে নসরুল হামিদ জানান, দেশের সমুদ্র অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য ‘বাংলাদেশ অফশোর মডেল পিএসসি ২০১৯’ হালনাগাদকরণের জন্য নিয়োজিত আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মতামত এবং পেট্রোবাংলার নিজস্ব পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ অফশোর মডেল পিএসসি ২০১৯ পরিমার্জনপূর্বক হালনাগাদ যুগোপযোগীকরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অফশোর মডেল পিএসসি ২০১৯ হালনাগাদকরণের পরে নতুন বিডিং রাউন্ড আগামী বছরের প্রথম নাগাদ ঘোষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহানের প্রশ্নের জবাবে নসরুল হামিদ বলেন, ‘দেশে বর্তমানে বছরে এলপিজির চাহিদা প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন। দেশে সরকারি পর্যায়ে উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ। বাকি চাহিদা বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।’
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কর্তৃক প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির মূল্য, মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের হ্রাস-বৃদ্ধি এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক) সমন্বয় করে দেশে বেসরকারি এলপিজির মূল্য সমন্বয় করা হয় বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
দেশের বেসরকারি এলপিজি আমদানিনির্ভর হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না কমলে সরকারের ভর্তুকি ছাড়া দেশের বাজারে বেসরকারি এলপিজির মূল্য সাশ্রয়ী করার সুযোগ নেই বলেও জানান জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।
মামুনুর রশীদ কিরণের প্রশ্নের জবাবে নসরুল হামিদ বলেন, ‘দেশে উত্তোলনযোগ্য প্রমাণিত ও সম্ভাব্য গ্যাস মজুতের পরিমাণ ২৮ দশমিক ৫৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। শুরু থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ক্রমপুঞ্জিত গ্যাসের পরিমাণ ১৯ দশমিক ৫৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে উত্তোলনযোগ্য অবশিষ্ট মজুত ৯ দশমিক শূন্য ৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসক্ষেত্র থেকে বর্তমানে দৈনিক গড়ে ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের বিবেচনায় অবশিষ্ট গ্যাসে ১০ দশমিক ৮ বছর ব্যবহার করা সম্ভব হবে।’
সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী জানান, গ্যাসের অপচয় রোধে আবাসিক পর্যায়ে ৪০ লাখ ৬২ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। বাকি আবাসিকে পর্যায়ক্রমে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হবে।
কাজী নাজিম উদ্দিনের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী জানান, বর্তমানে আটটি গ্রাহক শ্রেণিতে সংযোগকৃত অনুমোদিত গ্যাস লোড অনুযায়ী চাহিদা দৈনিক গড়ে ৩ হাজার ৭০০ ঘনফুট। এর বিপরীতে দৈনিক উৎপাদন গড়ে ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অবকাঠামোগত সক্ষমতা থাকলেও বৈশ্বিক সংকটে দৈনিক কমবেশি ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট সমপরিমাণ এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্রাহকদের চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সংকটের পরিমাণ দৈনিক গড়ে প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট।
জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজীর প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানান, ডিজেল বিক্রিতে বিপিসি লিটারপ্রতি ২১ টাকা লোকসান দিচ্ছে। ভবিষ্যতে যখনই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমবে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গার প্রশ্নের জবাবে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চিনিকলের লোকসানের কথা সংসদে উত্থাপন করেন। সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে চিনিকলগুলো পরিচালিত হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘ক্রমাগত ঋণের সুদ বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ ও লোকসান বৃদ্ধি পেয়েছে।’
সরকারের কাছ থেকে আখ ও চিনির দাম নির্ধারণ করার কারণে অনেক সময় বাজারের চাহিদা ও ভোক্তাদের বিষয় বিবেচনা করে চিনির দাম কমানোর প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আখের দাম স্থির থাকে বলে জানান তিনি। এতে লোকসান বেশি হচ্ছে। ফসলের বহুমুখীকরণের কারণে আখ চাষ কমে যাচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আখ উৎপাদন না হওয়ায় চিনিকলগুলোর লোকসান বাড়ছে।
উন্নত আখের জাত উদ্ভাবন না হওয়া, দক্ষ জনবলের অভাব এবং শ্রমনির্ভর কারখানা হওয়ায় চিনি আহরণের হার হ্রাস পেয়েছে। এ সময় চিনি শিল্পকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেনি তিনি।
নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের প্রশ্নের জবাবে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন জানান, দেশে ইউরিয়া সারের মজুত (২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত) ৭ দশমিক ৩৩ লাখ মেট্রিক টন। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নিরাপত্তা মজুত ৮ লাখ টনসহ সারের প্রয়োজন ২৫ দশমিক ৯৬ মেট্রিক টন। প্রয়োজনীয় ২৫ দশমিক ৯৬ মেট্রিক টন স্থানীয় কারখানায় উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানি করে চাহিদা পূরণের পরিকল্পনা রয়েছে।